রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পৃথিবীর বিলুপ্ত ধর্ম ও বিলুপ্ত দেবতাদের ইতিহাস : মনি ধর্ম (১ম পর্ব) # ৮৭



পৃথিবীর বিলুপ্ত ধর্ম ও বিলুপ্ত দেবতাদের ইতিহাস : মনি ধর্ম

২১৫-১৬ খ্রীস্টাব্দে ব্যাবিলনে জন্মগ্রহণকারী ‘মনি’ আরামাইক ভাষায় ৭টি ধর্মীয় পুস্তক রচনা করে তার ‘মনি ধর্ম’ প্রচার শুরু করেন। তার রচিত পবিত্র পুস্তকের নাম ছিল ‘জীবন্ত বা সুসমাচার (গসপেল), জীবনের রতœভান্ডার, গোপন কথার বই, উপদেশপত্র, সঙ্গীত ও প্রার্থনাগ্রন্থ, প্রাগমাটিয়া গ্রন্থ ও দৈত্যদের বই’। ২৭৬ খ্রীস্টাব্দে বর্ণিত পুস্তক রচনার কারণে ‘জিন্দিক’ বা মিথ্যা ধর্ম প্রচারক বলে জেলে প্রেরণ ও নির্যাতনে হত্যা করা হয় মনিকে। পরবর্তীতে তার ধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে, এমনকি তুর্কিস্থানে তার ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মনি ধর্মের অনুসারীরা ‘মনি’কে পূর্বেকার সকল নবীর উত্তরসূরী মনে করতো। এ ধর্মে পার্শীদের মত ২-সত্ত্বা তথা ‘আলো’ ও ‘অন্ধকারে’র কথা ছিল। তার মতে পৃথিবীর প্রথম প্রাণ হচ্ছে ‘আশাকলুন’ ও ‘নামরহিল’।

‘আশাকলুন’ ও ‘নামরহিল’ এর মিলনে জন্ম গ্রহণ করে ‘আদম’ ও ‘হাওয়া’। মানুষ আত্মাকে মানব জন্মের সময় মাংসের শরীরে বন্দী করে। তার মুক্তি ঘটবে শেষ বিচারে মাংসের শরীর থেকে, আর পৃথিবী জ্বলবে ১৪৬৮ বছর। মনি ধর্মীয় পুস্তকগুলো প্রায় বিলুপ্ত হলেও পরবর্তীতে তুর্কিস্থান, চীনের কিনকিয়াং ও মিশর থেকে এগুলো নানা উপায়ে একুশ শতকে উদ্ধার করা হয়। চীনের মনিধর্ম অনুসারী ‘উইগুররা’ ২০১১ সনে ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করতে থাকে। ফ্রান্সের আলবী শহরে, ইতালীতে এ ধর্ম প্রচলিত ছিল কিন্তু ১২০৮ সালে পোপের ক্রুসেডের ফলে এ ধর্মের বিলুপ্তি ঘটে। ২০১১ সনের দিকে এ ধর্মের মানুষ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি বিশ্বের তেমন কোথাও।

প্রাচীন পারস্যের এ প্রেরিত পুরুষের নাম ছিল Mani, তাঁর সময়কাল ২১০-২৭৬ খ্রিস্টাব্দ। প্রফেট (!) মনি ২১৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন দক্ষিণ ব্যাবিলনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সে সময়টায় ব্যাবিলন ছিল পারসিক সাম্রাজের অন্তর্গত। তিনি ছিলেন মনিবাদ বা Manichaeism-এর প্রবক্তা। মনির জন্ম হয়েছিল বাগদাদের কাছাকাছি এক পার্থিয় - ইরানীয় পরিবারে। মনির বাবার নাম ছিল 'পাটিগ' (কিংবা ফাটিক) আর মায়ের নাম 'মারিয়াম'। এরা ছিলেন মূলত হামাদানের লোক। ঐ সমগ্র অঞ্চলটি ছিল পারস্যের সাসানিয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। স্বর্গীয় এক দেবদূত মনিকে নতুন একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠার প্রত্যাদেশ দেন বলে তিনি জানান। আসলে ব্যাবিলনের অলিগলিতে ঘুরছিল এক ঘোরলাগা তরুণ। কে আমি ? আমি এখানে কেন? আমি কোথা হতে এলাম? যাবই বা কোথায়? এ প্রশ্ন নিয়ে পারস্যের পথে পথে ঘুরলেন মনি। অসংখ্য পারস্যবাসী তাঁর কথায় আকৃষ্ট হল। বেশির ভাগই সমাজের কোণঠাসা, দীনহীন, আর দরিদ্র। পারস্যের মেইনস্ট্রিম ধর্মটিও মনে শান্তি দিতে পারছে না তাদের। মনি যখন পারস্যে ধর্ম প্রচার করছিলেন তখন পারস্যে জরথুস্ট্র (Zoroaster) বাদের প্রবল প্রতাপ ছিল। সম্রাট শাহপুরের ভাই পেরোজ (ফিরোজ?) কে ধর্মান্তরিত করেছিলেন মনি। ধর্মপ্রচারের জন্য তুর্কিস্থান, মেসোপটেমিয়া, পারস্য, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিশর এবং ভারতের কুষান সাম্রাজ্যে মিশনারী পাঠিয়েছিলেন প্রফেট মনি। মনি নিজেকে সর্বশেষ প্রেরিতপুরুষ দাবি করেছিলেন ঐ সময়। তাঁর মতে অন্যান্য প্রেরিত পুরুষগণ হলেন- সেথ, নূহ নবী, ইব্রাহীম, শেম, নিকোথেওস(?), এনচ(?), জরথুস্ট্র (Zoroaster), বুদ্ধ ও জেসাস (যিশু)।

মনি Manichaeism (উচ্চারণ: ম্যানিকিইজম) ধর্মমতের প্রবর্তক ছিলেন। ধর্মটি ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের অভ্যূদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর আফ্রিকা থেকে চীন অবধি বিস্তৃত ছিল। অর্থাৎ ধর্মটির উদ্ভবের পর কয়েক শতাব্দী ধরে ম্যানিকিইজম বা মনিবাদ অপ্রতিরোধ্য ছিল এবং খ্রিস্টান ধর্মের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। ২০১৩ সন পূর্ববর্তী পৃথিবীতে ২১৫-১৬ খ্রীস্টাব্দে ব্যাবিলনে জন্মগ্রহণকারী ‘মনি’ প্রাচীন আরামাইক ভাষায় ৭টি ধর্মীয় পুস্তক রচনা করে তার এ ‘মনি ধর্ম’ প্রচার শুরু করেন। তার রচিত পবিত্র পুস্তকের নাম ছিল ‘জীবন্ত বা সুসমাচার (গসপেল), জীবনের রত্নভান্ডার, গোপন কথার বই, উপদেশপত্র, সঙ্গীত ও প্রার্থনাগ্রন্থ, প্রাগমাটিয়া গ্রন্থ ও দৈত্যদের বই’। ২৭৬ খ্রীস্টাব্দে বর্ণিত পুস্তক রচনার কারণে ‘জিন্দিক’ বা মিথ্যা ধর্ম প্রচারক বলে জেলে প্রেরণ ও নির্যাতনে হত্যা করা হয় মনিকে। পরবর্তীতে তার ধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে, এমনকি বিলুপ্ত তুর্কিস্থানে তার ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। মনি ধর্মের অনুসারীরা ‘মনি’কে পূর্বেকার সকল নবীর উত্তরসূরী মনে করতো। 

এ ধর্মে পার্শীদের মত ২-সত্ত্বা তথা ‘আলো’ ও ‘অন্ধকারে’র কথা ছিল। তার মতে পৃথিবীর প্রথম প্রাণ হচ্ছে ‘আশাকলুন’ ও ‘নামরহিল’। ‘আশাকলুন’ ও ‘নামরহিল’ এর মিলনে জন্ম গ্রহণ করে ‘আদম’ ও ‘হাওয়া’। মানুষ আত্মাকে মানব জন্মের সময় মাংসের শরীরে বন্দী করে। তার মুক্তি ঘটবে শেষ বিচারে মাংসের শরীর থেকে, আর পৃথিবী জ্বলবে ১৪৬৮ বছর। আত্মবিশ্বাসী মনি রোমান শাসকদের কাছেও তাঁর ধর্মের মূলকথা ব্যাখ্যা করে দূত পাঠিয়েছিলেন। মনির পরিবারটি যদিও ছিল পারসিক কিন্তু ‘মনি’ শব্দটি অবশ্য ‘আরামিয়’ ভাষার একটি শব্দ। আরামিয় ভাষা অর্থাৎ যে ভাষায় ফিলিস্তিনের যিশু কথা বলতেন। মনি যে সময়ে জন্মেছিলেন, সে সময়ে পারস্যের প্রধান ধর্ম ছিল জরথুস্ট্র (Zoroaster)বাদ। তবে এর পাশাপাশি পারস্যে নানা ধর্মসম্প্রদায় প্রচলিত ছিল। ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্ম বহু তরিকায় (সম্প্রদায়) বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সেখানে। মনির বাবাও সেরকম একটি মিশ্র উপ-ধর্ম পালন করতেন। পন্ডিতদের মতে, সে ধর্মটি ছিল প্রচলিত জরথুস্ট্র (Zoroaster)বাদী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এবং তাতে ইহুদি মতবাদের আধিক্য ছিল। জরথুস্ট্র (Zoroaster) বাদের তত্ত্বদর্শন ব্যাখ্যা করে নানা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম হল Manichaeism বা মনিবাদ। ইউরোপের আটলান্টিক উপকূল থেকে চীনের প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল অবধি ধর্মটির ব্যাপক বিস্তার হয়েছিল। মনি ধর্মীয় পুস্তকগুলো প্রায় বিলুপ্ত হলেও পরবর্তীতে তুর্কিস্থান, চীনের কিনকিয়াং ও মিশর থেকে এগুলো নানা উপায়ে একুশ শতকে উদ্ধার করা হয়।

মনির মৃত্যুর পরে ইউরোপ থেকে চীন অবধি তাঁর অনুসারীরা ছড়িয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী জুড়ে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল Manichaeism বা মনিবাদ। প্রথম জীবনে রাজদরবারের পৃষ্টপোষকতা পেলেও – এ মতবাদটি প্রচারের জন্য অশেষ নির্যাতন সহ্য করে অনিবার্য মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছিল মনিকে।

নিজস্ব মত প্রচারের জন্য অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন পারস্যের এ পুরুষ, যার শিক্ষা ছিল আত্মসংযম, নিরামিষ আহার, যৌনসংগম থেকে বিরত থাকা, উপবাস ও দান।

আগেই বলেছি মনির ধর্মটি ম্যানিকিইজম নামে পরিচিত। পারস্যে ধর্মটির দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। এতে জরথুস্ট্র (Zoroaster)বাদী পুরোহিতগণ রুষ্ট হচ্ছিলেন। মনিরও ভাগ্যাকাশে ঘনিয়ে উঠছিল দুর্যোগ। সম্রাট ধর্মদ্রোহী মনিকে আটক করার জন্য নির্দেশ দিলেন। সম্রাটের নির্দেশে চলে ভূগর্ভস্থ জেলখানায় মনির ওপর অমানুষিক নির্যাতন। মনির মৃত্যুর সালটি ২৭৬ খ্রিস্টাব্দ। আর সম্রাট প্রথম বাহরাম পারস্যের সম্রাট হন ২৭৪ খ্রিস্টাব্দে। মনি প্রসঙ্গে ইতালিও দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভ্যালির একবার বলেছিলেন, ‘ইতিহাসে সশস্ত্র পয়গম্বরগণ বিজয়ী এবং নিরস্ত্র পয়গম্বরগণ হন পরাজিত’। মনিও নিজেকে সর্বশেষ পয়গম্বর দাবি করেছিলেন, যদিও তাঁর বহু সহচর (সাহাবী) থাকলেও ঠিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল না তাদের, হয়তো এ কারণেই মনির ধর্ম পরাজিত এখন। মনি বলেছিলেন, আমিই সর্বশেষ পয়গম্বর। পন্ডিতেরা অবশ্য বলেন যে, মনির ধর্মমতের ওপর ভারতীয় প্রভাব ছাড়াও Gnosticism এর প্রভাব ও রয়েছে। Gnosticism হল আদিধর্ম। Gnosticism শিক্ষা দেয় যে, নিগূঢ় আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্দির মাধ্যমেই জগৎ সংসারের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। মনি বলতেন, বিশ্বজগতের শাসক ঈশ্বর। তবে জরথুস্ট্র (Zoroaster)র মতোই মনিও জগতের দ্বৈতরূপ অর্থাৎ জগতের শুভ অশুভের দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। একদিকে রয়েছে আত্মা বা আলোর জগৎ, অন্যদিকে অন্ধকার। মনির মতে বস্তু মাত্রই অশুভ। এ কারণে বস্তুর জগৎ শাসন করে শয়তান। মনি এও বলতেন যে, একদা আলো ও আঁধারের জগৎ দুটি পৃথক ছিল। আদি এক সংঘর্ষের পর অন্ধকারের জগৎটি আলোর জগতে আগ্রাসন চালায়। দুটি জগতের মিশ্রণ হওয়ার পর থেকে তারা এক শাশ্বত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন