শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৩০১৫ সনের ঐতিহাসিক যেভাবে বর্ণনা করবে ২০১৫ সনের প্রাচীন ভারতীয় জৈনধর্মের ইতিহাস # ৭৫

প্রাচীন ভারতীয় জৈনধর্ম

২০১৪ সন পূর্ববর্তী পৃথিবীতে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মহাবীর কর্তৃক এ ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল বলে মনে করতো জৈনরা। ভারতীয় ধর্ম এবং হিন্দু ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ধর্ম ছিল জৈনধর্ম। এ ধর্মে ধর্মনেতাকে ‘তীর্থংকর’ বলা হতো। মোট ২৪ জন ‘তীর্থংকর’ জৈন ধর্ম প্রচার ও প্রবর্তন করেন। অহিংসা, মিথ্যা পরিহার, চুরি পরিহার, সম্পত্তির মালিক না হওয়া, বিয়ে না করা জৈন ধর্মের প্রধান স্তম্ভ বা বিষয় ছিল। কমপক্ষে ২৫১১ বছর পূর্বে এ ধর্ম প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়। মহাবীর তথা শেষ তীর্থংকর আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পূর্ণতা প্রাপ্তির পর প্রথমে নির্গ্রন্থ এবং পরবর্তীতে ‘জিন’ নামে পরিচিতি পান। মহাবীর দিগম্বর তথা বস্ত্রহীন থাকতে পছন্দ করতেন। জৈন ধর্ম ছিল ঐ সময়ের বাস্তববাদী। তাদের কাছে প্রত্যেকটি প্রাণি বা জীব অত্যন্ত পবিত্র ছিল। এ ধর্মের অনুসারীরা ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতো না। এরা কেবল আত্মার নিত্যতা ও সত্যতা বিশ্বাস করতো। ‘জিন’ মানে কামনা-বাসনা ও বন্ধনমুক্ত আত্মা। জৈন ধর্মকে আর্হৎ বা নির্গ্রন্থ ধর্মও বলা হতো।

জৈনরা ২৪ জন তীর্থংকরকে তাদের ধর্ম প্রবর্তক বলে মনে করতো, মহাসম্মানিত তীর্থংকরগণ ছিলেন যথাক্রমে ঋষভদেব (নির্বাণস্থান-কৈলাসপর্বত), অজিতনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), সম্ভবনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), অভিনন্দন (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), সুমতিনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), পথপ্রভ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), সুপার্শ্বনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), চন্দ্রপ্রভ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), সুবিধিনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), শীতলনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), শ্রেয়াংসনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), বাসুপূজ্য (নির্বাণস্থান-চম্পাপুরী), বিমলনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), অনন্তনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), ধর্মনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), শান্তিনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), কুম্ভনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), অরনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), মলিস্ননাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), মুনিসুব্রত (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), নমিনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), অরিষ্টনেমি (নির্বাণস্থান-গির্ণারপর্বত), পার্শ্বনাথ (নির্বাণস্থান-পার্শ্বনাথপর্বত), মহাবীর (নির্বাণস্থান-পাবাপুরীপর্বত)
বৌদ্ধ যুগের সমসাময়িক ধর্ম ছিল জৈন। জৈন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলো অর্ধমাগধী, প্রাকৃত ও মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত ছিল। অসংখ্যা ধর্মীয় পুস্তকাদির মধ্যে ৮৪-টি ছিল স্বীকৃত। ৮৪টি শাস্ত্রের মধ্যে আবার সূত্রগ্রন্থ ৪১-টি এবং বাকিগুলো মহাভাষ্য। জৈন ধর্মের আবার দু’টো শাখা ছিল। একটি শ্বেতাম্বর অন্যটি দিগম্বর। শ্বেতাম্বরদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছিল ‘আগামা’। তাদের আগামার সংখ্যা ছিল ৪৫-টি। আবার দিগম্বরেরা ‘কর্মপ্রভ্রত’ এবং ‘অকাসয় প্রভ্রত’ নামক দু’টো গ্রন্থকে মহাপবিত্র মনে করতো। এ ধর্মটি মূলত অসাম্প্রদায়িক বা সেক্যুলার ছিল। জৈন ধর্মে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার চেয়ে ‘নাস্তিকতা’ তথা বস্তুবাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৩,৫০০-বছর আগেও। এরা সৃষ্ট জীবকে অনাদিকাল থেকে চলমান এবং অনাদিকাল ধরে চলবে বলে মনে করতো। সময় সম্পর্কেও সময়ের আদি ও অন্ত নেই বলে তারা মনে করতো। জৈন ধর্মমতে জীব ছাড়াও জড় পদার্থেরও প্রাণ আছে বলে মনে করতো তারা এবং এ জন্যে হত্যা, খুন ইত্যাদি এই ধর্মে চরমভাবে ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ ছিল। যোগ এবং মোক্ষকে তারা মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় মনে করতো। এদের মধ্যে বর্ণ প্রথা তথা অষ্পৃশ্যতা ছিল না। শ্বেতাম্বর জৈন উচ্চ শ্রেণির সন্যাসীরা বস্ত্রহীন থেকে হাত পেতে ভিক্ষা করতো এবং কালপিন সন্যাসীরা নেংটি পড়ে জীবন ধারণ করতো। দিগম্বর সন্যাসী গোষ্ঠীর প্রায় সবাই বস্ত্রহীন থাকতো।

সাধারণ জৈনদের শপথ নিতে হতো মাংস, মধু, মদ, ফল ও রাতের আহার পরিহার করার। তা ছাড়াও হিংসা, মিথ্যা, চুরি পরিহার ছাড়াও নিজ স্ত্রীকে নিয়ে সুখী থাকা এবং সীমিত সম্পদে তুষ্ট থাকার শপথও নিতে হতো একজন প্রকৃত জৈনকে। জৈনদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের নাম ছিল ‘পর্যুয়ন’। তাদের ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবে ছিল প্রাচীন ভারতের পার্শ্বনাথ পাহাড়, আবু পাহাড়, দিলওয়ারার মন্দির ইত্যাদি। হিন্দুদের মতে, ‘‘জৈনরা নাস্তিক ছিল’’। জৈনধর্মে মানুষের নানা বন্ধন তথা সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছিল যেমন, জড়ের বাঁধা, আত্মা নিজ দেহ নিজে নির্মাণ করে, পূর্ব কর্মের জন্যে দেহ ও ইন্দ্রিয়লাভ, জীবন বন্ধকের কারণ কষা, ভাববন্ধ ও দ্রব্যব্ধ। জৈনরা মনে করতো যে, যেহেতু জগৎ অনাদি তাই স্রষ্টার প্রশ্ন ওঠে না, প্রত্যেক পরিবর্তনের কারণ থাকলেও ঈশ্বরেরও কারণ থাকবে, সকল দ্রব্যের স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরেরও অবয়ব থাকবে ইত্যাদি। জৈনরা মূলত অ-ঈশ্বরবাদী হলেও, আসলে তারা জীব, জড় এবং কর্মবাদী ছিল।

এ ধর্মের অন্যতম অনুসারী মহাবীর দিগম্বর ও নিরীশ্বরবাদী নাস্তিক ছিলেন। তিনি দুঃখ ভোগকেই পাপস্খলন মনে করতেন। এরা মূলত প্রকৃতি ও নগ্নতাবাদী ছিল। এদের মতে ‘প্রকৃত জ্ঞানীর খাদ্যের কোন প্রয়োজন নেই’। তাদের মতে, পৃথিবীর সকল ধর্মীয় শাস্ত্র ও পুস্তক মানব রচিত। ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তর ও মধ্যপ্রদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এ ধর্মের অনুসারী ছিল না। জৈনরা নাস্তিক, এরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদকে স্বীকার করতো না। এরা যে কোন প্রাণি এমনকি তুচ্ছ কীটপতঙ্গ হত্যাকে ‘মহাপাপ’ মনে করতো এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনকে ঘৃণ্য হিসেবে দেখতো। জৈনদের মতে প্রচলিত তথাকথিত সকল দেবতার চেয়ে ‘মানুষ’ নানা বিচারে শ্রেষ্ঠ, দেবতাদের মুক্তি লাভের জন্যে তাদেরও মনুষ্য জীবন গ্রহণ করতে হবে। জৈনমতে গুণের প্রতীকই হচ্ছে আসলে ‘দেবতা’। সে অর্থে প্রত্যেক গুণী মানুষই আসলে ‘দেবতা’। ২০১৪ সনের পৃথিবীতে জৈন (Jainism) ধর্ম অনুসারী ছিল ৪২ লাখ, যার শুরু ৬-শতক। এর মধ্যে শেতাম্বর ৪০-লাখ, Sthanakavasis ৭,৫০,০০০ ও দিগম্বর ১,৫৫,০০০ প্রায়।

জৈন ধর্ম একসময়ে আদি ভারত উপমহাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য ধর্ম হলেও সমস্ত বাংলাদেশে তার প্রচার ও প্রসার ছিল না। জৈন ধর্ম যমুনা পার হয়ে পূর্বাঞ্চলে এসেছিল এমন কোন হদিস পাওয়া যায় না। পশ্চিম বাংলার পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গে এ ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল। তবে, পশ্চিম বাংলায় এ ধর্মের সাক্ষী হিসেবে মানভূম, সিংহভূম, বীরভূম ও বর্ধমান এ চারটি স্থানের নামই জৈন ধর্মের তীর্থাংকরদের নামের সঙ্গে জড়িত। জৈনপুরাণ মতে চব্বিশজন তীর্থাংকরের মধ্যে বিশজনেরই নির্বান স্থান হাজারীবাগ জেলার পরেশনাথ পাহাড়ে।
প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থে উলেখ আছে যে, বর্ধমান মহাবীর রাঢ় প্রদেশে ধর্মপ্রচারে এসেছিলেন, কিন্তু সেখানকার লোকেরা মহাবীর এবং তার সঙ্গী সাথীদের সাথে অসদ্ব্যবহার করেছিলেন। কোন সময়ে জৈনধর্ম বাংলায় প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তা সঠিক বলা না গেলেও মহাবীরের জীবদ্দশায় বা তারপর আরো দু’এক শত বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জৈনধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করে নি বলেই মনে হয়। দিব্যাবদানে অশোকের সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর জৈনগণ মহাবীরের চরণতলে পতিত বুদ্ধদেরেব চিত্র অঙ্কিত করেছে শুনে তিনি নাকি পাটলিপুত্রের সমস্ত জৈনগণকে হত্যা করেছিলেন। এই গল্পটির মূলে কতটা সত্য আছে বলা কঠিন। সুতরাং অশোকের সময় পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে জৈন-সম্প্রদায় বোধহয় ছিল না। তবে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে বঙ্গে যে জৈনধর্ম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন জৈনগ্রন্থ কল্পসূত্রমতে মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর শিষ্য গোদাস ‘গোদাসগণ’ প্রতিষ্ঠিত করেন, কালক্রমে তা চার শাখায় বিভক্ত হয়। এর তিনটির নাম তাম্রলিপ্তিক, কোটীবর্ষীয় এবং পুণ্ড্রবর্ধনীয়। এই তিনটি যে বাংলার তিনটি সুপরিচিত নগরীর নাম হতে উদ্ভূত, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কল্পসূত্রে উল্লিখিত, এ শাখাগুলি কাল্পনিক নয়; সত্যসত্যই ছিল। কারণ, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে তাদের উল্লেখ আছে। সুতরাং উত্তরবঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধন, কোটীবর্ষ ও দক্ষিণবঙ্গে (তাম্রলিপ্তি) যে খুব প্রাচীনকাল হতেই জৈনধর্ম প্রসার লাভ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে খ্রিষ্টীয় চর্তু শতাব্দীতে বা তার পূর্বে ঐ স্থান একটি জৈন বিহার ছিল।

জৈন ধর্মের বারানসীর ‘পঞ্চস্তুপীয়’ শাখার আচার্য গৃহনন্দীর শিষ্য ও তাদের অনুচরবৃন্দ বিহারের অধিবাসী ও কর্মকর্তা ছিলেন। তারা প্রতিবেশী এক ব্রাহ্মণ দম্পত্তির নিকট হতে কিছু ভূমি দানস্বরূপ লাভ করেছিলেন এই বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য। বিহারের ব্যয় বলতে অর্হৎদের নিত্য পূজা- সেবার ফুল, চন্দন, ধূপ ইত্যাদির ব্যয়। এর আরো দেড়শ’ বছর পরে য়ুয়ান-চুয়াঙ বাংলায় এসে, সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি বৈশালী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কলিঙ্গে দিগম্বর অবস্থায় প্রচুর জৈন দেখেছিলেন বলে উলেখ করেন। সম্ভবত তিনি আজীবিক সম্প্রদায়ের লোক দেখে জৈন মনে করে থাকতে পারেন, কারণ তখন দেশে প্রচুর সংখ্যক আজীবিক ছিলেন; যারা আসনে-বসনে, পূজাপার্বণে জৈনদের মতই ছিল। কাজেই য়ুয়ান-চুয়াঙ-এর মত বৌদ্ধের পক্ষে পার্থক্য করা হয়ত সম্ভব ছিল না। তবে, সম্ভবত পাল-আমলের শেষদিকে বীরভূম-পুরুলিয়া অঞ্চলে কোনো কোনো জায়গায় নির্গ্রন্থ জৈনদের সমৃদ্ধ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ৬২৯-৬৪৫ সাল পর্যন্ত হিউয়েন সাঙ ভারত ভ্রমণ করেন। বাংলা-ভ্রমণ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, তাঁর সময়ে বাংলায় দিগম্বর জৈনের সংখ্যা খুব বেশি ছিল। কিন্তু তার পরই বাংলায় জৈনধর্মের প্রভাব হ্রাস হয়। পাল ও সেনরাজগণের তাম্রশাসনে এই সম্প্রদায়ের কোন উল্লেখ নেই। তবে এটি যে একেবারে লুপ্ত হয় নি, প্রাচীন জৈনমূর্তি হতেই তা প্রমাণিত হয়।

জৈনরা এদেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে অনেক বেশি খবরা-খবর রাখত এবং অত্যন্ত সতর্কভাবে ধর্মপ্রচার ও জীবনযাপন করত। জৈন ধর্মগ্রন্থ ভগবতী সূত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে, আদিতে বাংলার বসবাসকারী জনমানুষের প্রতি জৈন ধর্ম প্রবর্তক মহাবীর বা তার অনুসারীদের ধারণা ভাল ছিল না- এমন কথা তারা উল্লেখ করে গেছেন।

ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে জৈনধর্ম প্রাচীন ভারতে প্রবর্তিত অন্যতম ধর্মমত। এই মত একই সঙ্গে ধর্ম ও দর্শন হিসেবে আলোচিত হয়। দর্শন হিসেবে এটি ভারতীয় দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ধর্মের মূল বক্তব্য হল সকল জীবের জন্য শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। বলা হয়ে থাকে, দৈব চৈতন্যের আধ্যাত্মিক সোপানে স্বচেষ্টায় আত্মার উন্নতি। যে ব্যক্তি বা আত্মা অন্তরের শত্রুকে জয় করে সর্বোচ্চ অবস্থাপ্রাপ্ত হন তাঁকে জিন (জিতেন্দ্রিয়) আখ্যা দেওয়া হয়। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতে জৈনধর্মকে শ্রমণ ধর্ম বা নির্গ্রন্থদের ধর্মও বলা হয়েছে। জৈন ধর্মের মূল গ্রন্থ হল ‘অগমা’। অপেক্ষাকৃত অপ্রধান গ্রন্থ হচ্ছে, আচারঙ্গ সূত্র, উত্তর অধ্যয়ন সূত্র, সূত্র কৃতঙ্গ। ঈশ্বরহীন এই ধর্ম মতে, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ মানব জীবনের পরম লক্ষ্য। কথিত আছে, তীর্থঙ্কর নামে চব্বিশ জন মহাজ্ঞানী কৃচ্ছ্বসাধকের একটি ধারা পর্যায়ক্রমে জৈনধর্মকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এদের মধ্যে তেইশতম তীর্থঙ্কর ছিলেন পার্শ্বনাথ (খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী) ও সর্বশেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন বর্ধমান মহাবীর (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)।

বর্ধমান মহাবীর তপস্যায় জ্ঞান লাভের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়কে জয় করেছেন বলে তাঁকে জিন বলা হয়। এই জিন থেকেই জৈন শব্দের উৎপত্তি। ভারতে এই ধর্মালম্বীদের সংখ্যা ১ কোটিরও বেশি। এ ছাড়া উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে। জৈনরাও সেটাই বিশ্বাস করে যে, তাদের ধর্ম সম্পূর্ণ মানব বিবর্তনের পথে প্রথম ধর্ম বা মানুষের আদি ধর্ম। তবে জৈন ধর্মমতের প্রথম তীর্থঙ্কর 'ঋষভ' কে পাওয়া যায় হরপ্পা সভ্যতারও আগে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে পাঁচ হাজার বছর আগেও এই ধর্ম প্রচলিত ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর খনন কাজ থেকে যে আদি ভারতীয় ধর্ম উঠে আসে, তা ছিল অষ্ঠাঙ্গিক যোগ নির্ভর। ঐতিহাসিক হেনরি মিলার ও জন মার্শাল মহেঞ্জোদারোর যোগী মূর্তিগুলোর ওপর গবেষণা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, এগুলি জৈন ধর্মের কায়সর্গর ( একটি বিশেষ যোগভঙ্গি যা জৈনরা অনুসরণ করে) পূর্বসূরী। মূলত হরপ্পা মহেঞ্জাদারোর ধর্ম ও আধ্যাত্ম-চেতনা আজো টিকে আছে জৈন ধর্মের মধ্যে দিয়ে।

জৈন ধর্মের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর অর্থাৎ চব্বিশতম তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীরের জন্ম বৈশালী নগরীর কুন্দলপুরের একটি ক্ষত্রিয় পরিবারে। রাজা সিদ্ধার্থ ও রানী ত্রিশলার সন্তান তিনি। তার স্ত্রীর নাম যশোদা। তারা মহাবীরের পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের অনুসারী ছিলেন। মহাবীরের সময়কাল ৫৯৯ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৫২৭ খ্রিষ্টপূর্ব [মতান্তরে ৫৪৯ খ্রিষ্টপূর্ব - ৪৭৭ খ্রিষ্টপূর্ব]। বর্ধমান মহাবীর ত্রিশ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এ সময়ে তিনি সর্বস্ব এমনকি পরিধেয় বস্ত্রও ত্যাগ করেছিলেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পরে ১২ বছরের তপস্যায় তিনি 'কেবল'জ্ঞান লাভ করেন। দিগম্বর অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন লোকালয়ে তাঁর মত প্রচার করতেন। তাঁর মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পর জৈনদের মধ্যে বিভাজন হয় এবং দুটি মতের সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্যে, দিগম্বর- যারা সম্পূর্ণ নিরাভরন থাকায় বিশ্বাসী এবং শ্বেতাম্বর- যারা অল্প বস্ত্র পরিধানে বিশ্বাসী।

দিগম্বর জৈন :
দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাসমতে একজন ভিক্ষু সবসময় নগ্ন অবস্থায় থাকেন। তার কারণ হলো একজন প্রকৃত ভিক্ষু কখনো পার্থিব বিষয়-সম্পত্তির অধিকারী হবেন না। তিনি জাগতিক আবেগ-অনুভূতি, যেমন- লজ্জা ইত্যাদি প্রদর্শন করবেন না। এমনকি একটি ভিক্ষাপাত্রও নিজের অধিকারে রাখতে পারবেন না। কথিত আছে এইরূপ একটি দল বাংলা অঞ্চল অতিক্রমকালে ওই সময় এই দেশের অধিবাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে নারীরা কখনও মোক্ষ লাভে সমর্থ নয়। তাদের মুক্তি বা মোক্ষ লাভের জন্য অন্য কোনো জন্মে পুরুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেই তা অর্জন করতে হবে। কারণ নারীরা যথার্থরূপে একজন যোগীর জীবন যাপন করতে সক্ষম নন। সামাজিক কারণেই তাদেরকে বস্ত্র পরিধান করতে হয়। একজন নারীর নগ্ন অথবা বস্ত্রহীন থাকাটা অবাস্তব ধারণা। তাছাড়া নারীরা স্বভাবজাতভাবে ক্ষতিকর।

শ্বেতাম্বর জৈন
এরা সাদা কাপড় পরিধান করেন। একটি ভিক্ষাপাত্রও নিজের অধিকারে রাখতে পারেন। তাদের হাঁটার পথ থেকে পোকামাকড় সরাবার জন্য একটি ঝাড়ুও সঙ্গে রাখেন। বইপত্র এবং লেখার সামগ্রীও তারা অধিকারে রাখতে পারেন।

জৈনদের ৫ মহাব্রত:
আচারগতভাবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তারা জৈন দর্শনের মূল বিষয়ে একমত। এগুলো বলা হয়-মহাব্রত; যার উদযাপনের কথা বর্ধমান মহাবীর বলে গেছেন। আর এগুলি হচ্ছে-

১.অহিংসা: জৈন ধর্মের মূলমন্ত্র অহিংসা। নিজের কথায় কাজে বা মননে যাতে কোন জীব ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেটা বিশেষভাবে মেনে চলতে হবে। অহিংসাই পরম ধর্ম। মহাবীর বলেছেন, ‘অহিংসার চেয়ে মহৎ কোন গুণ নেই এবং জীবের প্রতি প্রেমের চেয়ে বড় কোন পুণ্য নেই।’ কোনো প্রাণী বা জীবিত স্বত্তাকে আঘাত করা, গালাগাল করা, অপমান করা, পরাভূত করা, উৎপীড়ন করা, হয়রানি করা বা হত্যা করা জঘন্য অপরাধ। জৈনমতে সহিংসতার তিনরূপ রূপ- দৈহিক উৎপীড়ন, মানসিক উৎপীড়ন ও বাচনিক উৎপীড়ন।
২.সুনৃত (সত্য): সুনৃত শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, যে কথা শুনলে অপরের আনন্দ হয়, যে কথায় লোকের মঙ্গল হয় ও তার পরিনাম সুন্দর হয়, তাকেই সুনৃত বলে। জৈন মতে একজন পুত্র যেমন মাকে বিশ্বাস করতে পারে, মানুষের সততা সেই পর্যায়ের হওয়া উচিত যাতে তোমাকে সবাই মায়ের মতন বিশ্বাস করবে। আর যদি সততার জন্যে হিংসার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে, জৈন নীতি অনুযায়ী নির্বাক থাকায় শ্রেয়।
৩. মূলত (অচৌর্য): মানুষ তার নিজস্ব অর্জনে তৃপ্ত থাকবে। অপরের প্রাপ্য সঠিকভাবে পরিশোধ করবে। অপরের সম্পদে লোভ করবেনা।
৪. ব্রহ্মচর্য: সকল প্রকার বিলাসিতা, ইন্দ্রিয়সেবা, অসংযম থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। গৃহীগণ আপন বৈধ সঙ্গী ছাড়া কারো সাথে ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগ করবেনা। যার গৃহী নন অর্থ্যাৎ, সন্তরা চিত্ত নিবৃত্ত করে ইন্দ্রিয়সুখ থেকে বিরত থাকবে।
৫. অপরিগ্রহ: সম্পদে বা সম্পর্কে কারো অধিকার নাই। বর্তমান হচ্ছে সম্পদের রক্ষক, ভবিষ্যতের হাতে সমর্পণের জন্য। সন্তদের জন্য সব ধরনের সম্পদ ও সম্পর্ক পরিত্যাজ্য।

মুক্তি বা নির্বাণ লাভ :
জৈন ধর্মে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই। তারা আত্মাতত্ত্বে বিশ্বাসী। মানুষের আত্মা দেহের উপর ভর করে মুক্তির পথে পরিভ্রমণরত। বার বার জন্মগ্রহণ করে কর্মক্ষয়ের মাধ্যমে সমস্ত বন্ধন মুক্ত হয়ে নির্বাণ প্রাপ্তির মাধ্যমে মোক্ষ লাভ। এই মোক্ষ লাভ করলেই দেহ থেকে আত্মার মুক্তি। আর জন্মগ্রহণ করতে হবেনা। দেহধারণ মানেই হচ্ছে, রোগ, শোক, যন্ত্রনা, মৃত্যু ইত্যাকার বিবিধ বিষয়ের সম্মুখীন হওয়া। এই দিক থেকে এই ধর্মের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের মিল রয়েছে।
আত্মার মুক্তির পরিক্রমায় পঞ্চস্থিতি নামে পাঁচটি স্তর রয়েছে পঞ্চস্থিতি- ১. অরহত, ২. সিদ্ধ, ৩. আচার্য, ৪. উপাধ্যায় ও ৫. সাধু। তপস্যা ও কর্মক্ষয়ের মাধ্যমে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে পরম আত্মিক উৎকর্ষের মাধ্যমে পুণ্যাত্মা পায় পরম মুক্তি। এছাড়া জৈন ধর্মে জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধ, সংভর, নির্জরা ও মোক্ষ নামে সাতটি তত্ত্ব আছে।

জৈন ধর্মে তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে অষ্টপ্রকারী পূজা করা হয়- জলপূজা, চন্দনপূজা, পুষ্পপূজা, ধূপপূজা, দীপকপূজা, অক্ষতপূজা, নৈবেদ্যপূজা ও ফলপূজা। অহিংসা ও পরমত সহিষ্ণুতা এই ধর্ম ও দর্শনের সবচেয়ে বড় উপাদান। এছাড়া ভারতবর্ষের শিক্ষা ও ভাষার ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। জৈনরা প্রাচীন শ্রমণ অর্থাৎ, কৃচ্ছ্বসাধনার ধর্মকে আজও বহন করে নিয়ে চলেছেন। ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব সবিশেষ। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের প্রথা জৈনদের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান। ভারতে এই সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হারও বেশি। এছাড়া এই অঞ্চলের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারও তাদের।

ভারতবর্ষে প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষার উন্নতি ও অগ্রগতিতে জৈন ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম। তেইশ নম্বরে তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ছিলেন কাশির এক রাজার পুত্র। যিনি রাজপ্রাসাদের জৌলুসতা পরিত্যাগ করে শুধু ধর্মীয় অনুভূতির কারণেই সংসার ত্যাগ করেন। কঠোর সাধনা ও আধ্যাত্ম চর্চার মাধ্যমে তীর্থঙ্করের মর্যাদা লাভ করেন। তার উপদেশাবলির সমন্বয়ে 'চতুর্যাম' নামক জৈন ধর্মের গ্রন্থ রচিত হয়। যা জৈন ধর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পার্শ্বনাথ যখন তার চতুর্যাম রচনা করেন তখন প্রাকৃত ভাষার জীবন-মৃত্যু সন্ধিক্ষণ। সংস্কৃত ভাষার প্রচলনই ব্যাপক। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় গ্রন্থাদি রচিত হওয়ায় ধর্মের প্রসারের মধ্য দিয়ে প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষারও ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। ধর্ম প্রচার ও ধর্মীয় বাণীর প্রসারকল্পে তখন জৈন ধর্মে প্রাকৃত ও সংস্কৃতই মাধ্যমে পরিণত হয়।

সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা বাদেও তৎকালীন কথ্য ও চলিত ভাষার সমন্বয়ে অন্য একটি ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল তার নাম 'অধর্মগধ'। মহাবীর তার ধর্মের বাণী রচনা করেছিলেন অধর্মগধ ভাষায়। এটি ছিল মূলত একটি মিশ্র ভাষা। বর্তমান ভারতের হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি প্রভৃতি ভাষার উৎপত্তির আগে এদেশে অন্য যেসব ভাষা ব্যবহৃত হতো জৈন সাধক পুরুষরা ধর্ম প্রচারের সুবিধার জন্য ওইসব ভাষার সমন্বয়ে 'অপভ্রংশ' নামে নতুন একটি ভাষার প্রচলন ঘটান। এ অপভ্রংশের ব্যবহারে নানা ভাষার যোগসূত্রতা রয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় জৈনদের মাধ্যমে তামিল ভাষারও উন্নতি সাধিত হয়েছিল।

এই হচ্ছে ২০১৪ সনের পৃথিবীর মানুষের নানাবিধ ধর্মের ইতিহাস অথচ আজ ৩০১৪ সনের মানুষের কাছে এসব ধর্ম কেবলই হাস্যকর ইতিহাসের অংশ। আসুন বিশ্বের ২০১৪ সনে প্রচলিত কিন্তু বর্তমানে বিলুপ্ত সব ধর্মকে জানি, বোঝার চেষ্টা করি সত্যাসত্য আর নিজের বিবেক আর বোধকে আরেকবার ঝাকুনি দেই। তা কি দেয়া যাবে ৩০১৪ সনে? অবশ্যই যাবে? কারণ তা কি ২০১৪ এর মানুষের মত যুক্তি আর বোধহীন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন