সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার ইতিহাস পর্ব- ৮ # ১১০

আধুনিক অসাম্প্রদায়িক মানুষের দৃষ্টিতে ইহুদি জাতির ইতিহাস [ পর্ব – ৮ ]
 
ইহুদি ধর্মের উদ্ভব ও একেশ্বরবাদ : ওল্ড টেস্টামেন্টের আলোকে
 
বিশ্বের ধর্ম-বিশ্বাসীদের বড় অংশ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। পৃথিবীর অন্যতম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেমেটিক ধর্ম হিব্রু, খৃস্টান ও ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য হলো একেশ্বরবাদ। একেশ্বরবাদ প্রথম দেখা যায় হিব্রু ধর্মে পরবর্তী দু’টি ধর্ম এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। হিব্রু ধর্মেই প্রথম প্রকাশ করা হয় যে, “ঈশ্বর কোন বিমূর্ত ধারণা নয়, তা হলো এক জীবন্ত বিষয়”। হিব্রুগণ ইসরাইলি, ইহুদি ও জুডান এবং হিব্রু ধর্ম ইহুদি ধর্ম বা জুডাইজম নামেও পরিচিত। প্রায় দেড় হাজার খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিগণ ছিল ক্ষুদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর মানুষ, যারা বারে বারে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে। তারা বিশ্বের ইতিহাসে যুদ্ধ, কূটনীতি, স্থাপত্য বা শিল্পক্ষেত্রে খুব সামান্যই অবদান রেখেছে কিন্তু নীতিশাস্ত্র ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ইহুদিগণ যে ভূমিকা রাখে তা অভূতপূর্ব। বস্তুত রাজনৈতিক শক্তিতে এত দুর্বল আর কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীর ইতিহাসকে এতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করেনি, যতটা করেছিল হিব্রু বা ইহুদিগণ।

 
হিব্রু বা ইহুদিগণ বিশ্বে প্রথম একেশ্বরবাদের বাণী প্রচার করেছিল। তারা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই একেশ্বরবাদী ছিল না। একেশ্বরবাদের ধারণায় তারা উপনীত হয়েছিল কয়েক শ’ বছরের দীর্ঘ এক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। হিব্রু জাতির ইতিহাসের সাথেই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে তাদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেষ্টামেন্ট। এই গ্রন্থে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে ইহুদি জাতির উত্থান, পতন ও বিশ্বাসের কাহিনী। বস্তুত ইহুদি বা হিব্রু ধর্ম সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই অপরিহার্যভাবে এসে পড়ে হিব্রু জনগণের ও তাদের জীবনযাপন প্রণালীর কথা। ইহুদি জনগণকে বাদ দিয়ে তাদের ধর্ম সম্পর্কে বলতে গেলে তা সম্পূর্ণ বলা হয় না। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ পর্যন্ত ইহুদি জাতির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে ওল্ড টেষ্টামেন্টে। এই গ্রন্থের অংশ বিশেষ লেখা হয় আরামিক ভাষায় বাকি অংশ হিব্রু ভাষায়। পরবর্তীতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীগণও ওল্ড টেস্টামেন্টকে তাদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এর সাথে যিশু খ্রিস্ট কর্তৃক প্রচারিত বাণীসমূহ যোগ করে। এই উভয় অংশ একত্রে সাধারণভাবে বাইবেল নামে পরিচিত। অবশ্য যিশু কর্তৃক প্রচারিত বাণীসমূহ লিখিত হয়েছিল গ্রিক ভাষায়। আলোচ্য প্রবন্ধে ওল্ড টেস্টামেন্টের উপর ভিত্তি করে ইহুদি জাতির একেশ্বরবাদে উপনীত হবার পর্যায়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। হিব্রু ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে, এই ধর্মেই প্রথমে একেশ্বরবাদের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম খ্রিস্টান ও ইসলামে তা অনুসৃত হয়েছে। ইহুদিগণ ঈশ্বরকে যেভাবে দেখেন তা হলো;
 
ক. বিশ্বজগতের স্রষ্টা একক এক সত্তা;
খ. স্রষ্টা সর্বশক্তিমান;
গ. স্রষ্টা নিরাকার, তাঁর বস্তুগত কোন আকার নেই;

এ ছাড়া ঈশ্বরের বিধান লঙ্ঘন করলে পাপ হয় এবং পাপের ফলে শাস্তি পেতে হয়, এ ধারণারও বিকাশ ঘটায় হিব্রুগণ। ইহুদি জাতি এই বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশ ঘটিয়েছিল সুদীর্ঘকালব্যাপী এক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, যার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে এই জাতির ভাগ্য বিপর্যয়ের দীর্ঘ ইতিহাস।
 
ইহুদি জাতির আদি বাসস্থান ছিল মেসোপটেমিয়া বা বর্তমান ইরাকে। তৎকালীন মেসোপটেমিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল যারা অধিকাংশ সময়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী, ইহুদি জাতির পূর্বপুরুষ আব্রাহম এই মেসোপটেমিয়ার উর নগরের অধিবাসী ছিল। এই পর্যায়ে ইহুদি বা হিব্রু ধর্ম ছিল অন্য সব ধর্মের মতোই প্রকৃতি-পূজারী ও বহু-ঈশ্বরবাদী। দেবতা বা ঈশ্বরগণ ছিল মানুষের মতো আকৃতি বিশিষ্ট। ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ আছে যে, ঈশ্বরগণ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাদের প্রতিমূর্তিতে। এই পর্যায়ে ঈশ্বর মানুষের মুখোমুখি হতো, কথা বলতো। আব্রাহামের পৌত্র জেকবের উপাধি ছিল ইসরাইল, তা থেকে ইহুদি জাতির নাম হয় ইসরাইল। জেকব (ইয়াকুব) তাদের দেবতার সাথে যুদ্ধ করে দক্ষতা প্রদর্শন করেন বলে তার নামকরণ করা হয় ইসরাইল বা ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধকারী।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন