বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইসলামি শিরোচ্ছেদ (কতল-কিসাস) ও রজম : প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে [ পর্ব - ১ ] # ১৩৮

ইসলামি শিরোচ্ছেদ (কতল-কিসাস) ও রজম : প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে [ পর্ব - ১ ]
এ লেখাটি কয়েকটি পর্বে সমাপ্ত হবে, সম্পূর্ণ লেখাটির জন্যে এখানে চোখ রাখুন

শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড অনেক পুরণো। প্রাগৈতিহাসিক বেবিলনিয় রাজা ‘হাম্বুরাব্বী’ (খ্রী.পূর্ব ১৭৯২-১৭৫০) সম্ভবত বিশ্বে প্রথম আইন হিসেবে শিরেচ্ছেদের প্রচলন করেন। ইউরোপের দেশগুলোতে গিলোটিন, ক্রুশবিদ্ধ ও বিষপানে হত্যা প্রথা প্রচলিত থাকলেও, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রাচীনকাল থেকেই শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে হত্যা প্রচলিত ছিল।

ইসলামী আইনে বেশ কিছু ‘কঠিন’ অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড তথা শিরোচ্ছেদের বিধান করা হয়েছে। বর্তমানে অনেক দেশ সরাসরি শিরোচ্ছেদ না করে অন্যভাবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলেও, সৌদি আরব এখনো প্রকাশ্যে ‘শিরোচ্ছেদ’ কার্যকর করে থাকে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে শিরোচ্ছেদ কার্যক্রমটির পুরো চিত্র এখানে পাঠকের অবগতির জন্যে তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।

সাধারণত হত্যা, মাদক পাচার, ধর্ষণ, ধর্ম অনানুমোদিত সেক্স , ধর্মত্যাগ, কোরান-আল্লাহ-নবীর সমালোচনা তথা ধর্মের অবমাননা, পশুর সাথে সেক্স, সমকামিতা, সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ইত্যাদি অপরাধের জন্যে সৌদি আরবে শিরোচ্ছেদ করা হয়ে থাকে। রায় প্রদানের পরবর্তী কার্যক্রম সমাপ্তির পর, সাধারণত নিকটবর্তী পরের যে কোন শুক্রবার শিরোচ্ছেদটি কার্যকর করা হয়। প্রাদেশিক বড় বড় শহরগুলোর প্রধান মসজিদের সামনের মাঠে শুক্রবার জুমার নামাজের পর পরই প্রকাশ্যে শিরোচ্ছেদ করা হয়ে থাকে। রিয়াদ ছাড়াও জেদ্দা ও মক্কাকে প্রকাশ্যে শিরোচ্ছেদ করা হয়। সাধারণত মাসের ২-১টি শুক্রবার বাদে প্রায় প্রতি শুক্রবারই শিরোচ্ছেদ করা হয়। কমপক্ষে একজন এবং একসঙ্গে ৬-জনের শিরোচ্ছেদ দেখার সুযোগ বর্তমান লেখকের হয়েছিল। জেদ্দা শহরের ‘বালাদ’-এর প্রধান মসজিদের সামনে যেভাবে শিরোচ্ছেদ কার্যকর করা হয়, এখানে তার হুবহু বর্ণনা দেয়া হল।

জেদ্দার ‘বালাদ’-এর প্রধান মসজিদটি হোটেল ‘রেড-সি’ প্যালেস লাগোয়া ১০০-১৫০ গজ উত্তর-পূর্ব দিকে। ঐ মসজিদের সামনেই শিরোচ্ছেদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্যে নির্মাণ করা হয়েছে একটি মাঠ, যার মাঝখানে কনক্রিট নির্মিত একটি প্লাটফরম। সাধারণত সপ্তাহের অন্যান্য দিন ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র বিধায়, মসজিদের সামনের মাঠটি গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে শুক্রবার শিরোচ্ছেদ অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্যে সকাল থেকেই মাঠটিতে পুলিশ পাহারা বসানো হয়, যাতে কেউ পার্কিং করতে না পারে। সকাল থেকে পুলিশের পাহারা দেখেই বোঝা যায় যে, ঐদিন শিরোচ্ছেদ কার্যক্রমটি সম্পন্ন করা হবে।

বেলা ১২-টার মধ্যে মাঠের চারদিক বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ বাহিনী মাঠকে ঘিরে ফেলে। পর্যায়ক্রমে প্রথমে বিচারক বা কাজী মাঠে উপস্থিত হয়ে বিশেষ মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। তার সাথে থাকে শিরোচ্ছেদ কার্যক্রমটি সম্পন্ন করার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘জল্লাদ’। সৌদি জল্লাদরা প্রায় সবাই কালো নিগ্রো তথা হাবসী বংশের। জল্লাদদের কোমড়ে গোজা থাকে চিকন, লম্বা অথচ অত্যন্ত ধারালো তরবারী। যত জনের শিরোচ্ছেদ করা হবে, তত জন জল্লাদ আনা হয়। জল্লাদরা কাজীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এর পর পরই আসে ডাক্তার, এ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। ডাক্তার আসে শিরোচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ‘মৃত্যুর’ ঘোষণা দেয়ার জন্যে, এ্যাম্বুলেন্স আসে শিরোচ্ছেদকৃত ব্যক্তির মাথা ও শরীর বহন করার জন্যে এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও লোকজন থাকে রক্ত ধুয়ে মুছে দেয়ার জন্যে। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে মসজিদে জুমার নামাজ শুরু হলে মাঠে অবস্থানরত কাজী, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই, এমনকি উপস্থিত সাধারণ জনতাও যার যার স্থানে দাঁড়িয়েই জুমার নামাজ আদায় করে। পুলিশরাও তাদের পায়ের জুতা নিয়েই নামাজে দাঁড়ায়। কারণ নামাজ সেখানে বাধ্যতামূলক।

নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষ কালো গাড়িতে কালো কাপড়ে চোখ ও পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিশেষ কমান্ডো পুলিশের সহায়তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে মাঠের মাঝখানের উঁচু প্লাটফর্মে নামাজের ভঙ্গিতে বসানো হয়। বসানোর পরই চোখের কাপড় খুলে দেয়া হলেও, একটু দূরেই কমান্ডোরা অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে থাকে। উপস্থিত কাজী আরবী ভাষায় তার বক্ততায় দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম, পরিচয়, জাতীয়তা, অপরাধ ইত্যাদির বর্ণনা দিতে থাকা অবস্থায়, পাশে দাঁড়ানো ‘জল্লাদ’ খাপ থেকে তলোয়ার বের করে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ঐ সময় দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিংবা ফ্যাল-ফ্যাল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকায়। সম্ভবত তাকে কোন ‘বোধ-নাশক’ ঔষধ প্রয়োগ করা হয়, যাতে মৃত্যুর আগে সে তেমন কোন ‘সিন-ক্রিয়েট’ না করতে পারে।

কাজীর বর্ণনা শেষ হওয়া মাত্র একটুও দেরী না করে জল্লাদ তরবারী দিয়ে সজোরে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ঘারের মাঝ বরাবর আঘাত করে, প্রথম আঘাতেই দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে একটু দূরে গিয়ে পড়ে এবং দেহটি হাত বাঁধা থাকে বিধায় একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। এক-দেড় মিনিট সামান্য নড়াচড়া করার পর সাধারণত শিরোচ্ছেদকৃত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

কিন্তু একবার ৬-জন দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ৫-জনেরই মাথা তরবারীর প্রথম আঘাতেই দেহ থেকে আলাদা হলেও, একজনের মাথা আলাদা না হয়ে দেহের সঙ্গে বসা অবস্থায় ঝুলতে থাকলে, জল্লাদ পা দিয়ে লাথি দিয়ে মানুষটিকে উল্টে দ্বিতীয়বার আঘাতে তার মাথা দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। তরবারীর আঘাতে মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সৌদি নাগরিকগণ তথা আরববাসীর প্রায় সবাই হাত-তালি, শিষসহ উল্লাস প্রকাশ করে। কেউ কেউ কর্তিত মাথার দিকে থু-থু নিক্ষেপ করে। এটি সম্ভবত করে বাদী-পক্ষের লোকজন কিংবা তাদের আত্মীয় স্বজন প্রতিশোধ বা ন্যায় বিচার পাওয়ার খুশিতে।

তবে উপস্থিত অনারব তথা ভারতীয় উপমহাদেশীয় লোকজন দৃশ্যটি অবলোকন করে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে এবং সারাদিন তারা বিমর্ষ অবস্থায় সময় কাটায়। ডাক্তার কর্তৃক মৃত্যু ঘোষণার পর প্রত্যেকটি দেহ ও মাথা আলাদা আলাদা এম্বুলেন্সে তুলে এম্বুলেন্স দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগে করে। ফায়ার সার্ভিসের হোস-পাইপ দিয়ে স্থানটির রক্ত ইত্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করা হয়। ক্রমান্নয়ে কাজীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই স্থান ত্যাগ করে।


[এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত পোস্ট পাবেন আজই পরবর্তী পর্বগুলোতে। এরপর পর্ব ২ ]





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন