সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

২০১৫ সন পূর্ববর্তী বিশ্বের মানুষের ধর্ম ও দেবতাদের ইতিহাস : ১ # ১২৩

২০১৫ সন পূর্ববর্তী বিশ্বের মানুষের ধর্ম ও দেবতাদের ইতিহাস : ১ 
২০১৫ সন পূর্ববর্তী বিশ্বের মানুষের ধর্ম ও দেবতাদের ইতিহাস : প্রাককথন
 
পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক মানবের কাহিনী মানেই হচ্ছে ধর্মের ইতিহাস। ঈশ্বর, আত্মা, স্রষ্টা, অমরতা, মৃত্যু, স্বর্গ, নরক ইত্যাদির নামই এক অর্থে ধর্ম। আসলে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের মৃত্যু, ভয় ও অসহায়ত্ব থেকে, যাতে পুরোহিতরা নানাভাবে মশলা দিয়েছে এতে, দিয়েছে নিজেদেরই স্বার্থেই। হাজার বছর থেকে আজকের নৃতাত্ত্বিকগণ উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে নানাবিধ গবেষণা করে যা পেয়েছে তা হচ্ছে, সর্বপ্রাণবাদ থেকে উপাসনা তত্ত্ব (টেইলর), মৃত পূর্বপুরুষদের উপাসনা থেকে প্রেতপুজো তত্ত্ব (স্পেনসর), বংশ প্রতীক বা টোটেমতত্ত্ব (স্মিথ), রহস্যময় শক্তির কাছে আত্মসমর্পন তত্ত্ব (দুর্খাইম), ‘মানা’ বা অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস তত্ত্ব (কর্ডিনটন), জাদু বিশ্বাস থেকে ধর্মতত্ত্ব (ফ্রেজার) ইত্যাদি। ২০১৩ পূর্ববর্তী প্রাচীন দার্শনিক এরিখ ভন দানিকেলের মতে, ‘‘মানুষের আদিম অবস্থায় মহাকাশ থেকে ভিনগ্রহের অধিবাসীরা এসে পৃথিবীতে নানাবিধ ‘কারিশমা’ দেখিয়ে আবার মহাকাশে ফিরে যায়, পৃথিবীর আদিম অজ্ঞ মানুষেরা মহাকাশ যানে আগত ও প্রত্যাগত ভিন গ্রহের প্রাণিদের অত্যাশ্চর্য কর্মকান্ডে বিমোহিত হয়ে তাদের দেবতা জ্ঞানে পুঁজা করা শুরু করে, বানায় তাদের নামের বিভিন্ন উপাসনা মন্দির, যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে’’।

২০১৫ পূর্ববর্তী প্রাচীন নানা ধর্মে জাদুকর থেকে মুনি, ঋষি, আধ্যাত্মবাদী পুরোহিত সৃষ্টি হয়েছে এর সুষ্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন হিন্দু ধর্মেও ‘টাবু’ বা টোটেম প্রথা চালু ছিল বৈদিক যুগে কিংবা তার আগেও। বলিদান প্রথার মূলেও ছিল টোটেমবাদ (স্মিথ), শক্তির উপাসনা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন প্রপঞ্চে চলমান ছিল। প্রাচীন ফোনিকান, হিব্রু, ক্যানানাইট, মায়া, ইনোকা, আজটেক, ওলমেক্স, গ্রীক, রোমান, কার্থাগিনিয়ান, টিউটন, সেল্ট, ড্রুইড, গল, থাই, জাপানী, নিউজিল্যান্ডের মাউরি, তাহিতিয়ান ও হাওয়াই দ্বীপের মানুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী শিশু, নারী ও পুরুষ বলি দিতো দেবতাকে তুষ্ট করার জন্যে। 

 ২০১৫ পূর্ববর্তী পৃথিবীর প্রাচীন ইনোকা, মায়া, মিশর, মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন, গ্রিস, চীন, চ্চু-পিচু, ইরান, ভারত প্রভৃতি সকল সভ্যতায় ধর্ম খুঁজে পাওয়া যায় নানাবিধ রং ও ঢংয়ে। তখন ধর্মের সর্বত্রই উপাসনা তথা অলৌকিকে নিজেদের সর্মপণ বোঝাতো। কোন কোন ধর্মে যেমন হিন্দুদের ঈশ্বর সাকার ছিল, আবার ইহুদী-মুসলমানদের স্রষ্টা ছিল নিরাকার। ধর্ম এসেছিল ‘সৃষ্টি থাকলে স্রষ্টা থাকবে’ এই মতবাদ থেকে। ঐ সময়েই যুক্তিবাদী অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘‘তবে ঈশ্বরের স্রষ্টা কে’’? যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি কোন ধর্ম প্রবর্তক কিংবা প্রণেতারা! ২০১৫ পূর্ববর্তী প্রাচীন নৃবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের মধ্যে প্রথম ধর্মবিশ্বাস জন্মে ‘নিয়ান্ডার্থাল’ মানুষের আমলে, যা এখন থেকে বহু বছর আগে। ধর্মের উৎপত্তি কমবেশী আনুমানিক ১০,০০০ বছর হলেও, পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও বসবাস কমপক্ষে এক লক্ষ বছর আগে। প্রাক প্রাথমিক যুগের আদিম মানুষের ধর্মে বিশ্বাস ছিল না। আসলে ঐ সময় ধর্ম মানে ছিল নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে মানব জাতির আত্মসম্মান বিসর্জন। যদিও ২০১৫ পূর্ববর্তী প্রাচীন পাশ্চাত্যে ক্রমান্নয়ে উপাসনা ধর্ম কমতে শুরু করেছিল কিন্তু পৃথিবীতে একুশ শতকেও ধর্মের জয়জয়কার ছিল সর্বত্রই এশিয়া, ইউরোপ তথা আফ্রিকায়!

পৃথিবীর প্রাচীন কাল থেকে ২০১৫ পূর্ববর্তী প্রাচীন পৃথিবীতেও আজকের ৩০১৫ সনের মত নাস্তিক্য ও যুক্তিবাদী মানুষের মধ্যে বুদ্ধ, মহাবীর, চার্বাক, দেকার্ত, স্পিনোজা, মার্কস, হেগেল, ভলতেয়ার, কভুর, ডিরোজিও, আরজ আলী মাতবর, ফায়ারবাখ, এ্যাঙ্গেলস, কান্ট, লেনিন, মাও সেতুং যুক্তিবাদকে স্থান দিয়েছিলেন জীবনে ধর্মের অনেক উপরে। মাও পৃথিবীর প্রথম কৃষি সাম্যবাদের রূপকার ছিলেন, যার অনুকরণে প্রাচীন ভারতে নকশালবাড়ি আন্দোলন হয়েছিল চারু মজুমদারের নেতৃত্বে। এ আন্দোলনগুলো আসলে ধর্মের প্রতি প্রচন্ড ধাক্কা দিলেও, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস তখনো পৃথিবীতে পূর্ণ অবয়বে বহমান ছিল। ২০১৫ পূর্ববর্তী মানুষের জীবনে ধর্ম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। ঐ সময় নানাভাবে ধর্ম প্রভাব বিস্তার করতো মানুষের জীবনে। 

মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সকল ক্রিয়াকলাপই বলতে গেলে ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করতো। মানুষের জন্মের প্রথম দিকে নাম রাখা থেকে শুরু করে তার শিক্ষা, বিয়ে, খাদ্য, সঙ্গী নির্বাচন, উৎসব, ঘর সংসার ইত্যাদি দৈনন্দিন সকল কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতো ধর্ম। ঐ সময় খুব কম মানুষই পৃথিবীতে বসবাস করতো, যারা কোন না কোন ধর্মের অনুসারী ছিলনা। কেউ কেউ অবশ্য অদৃশ্য ও অলৌকিক ধর্মকে মানতে চাইতো না কিংবা ধর্মে অবিশ্বাস করতে চাইতো যুক্তি দিয়ে। তৎকালীন সমাজ এদেরকে সুনজরে দেখতো না। কোন কোন মানব সমাজে ধর্ম নিয়ে যুক্তিবাদীদের কিংবা ধর্মহীন মানুষকে ‘নাস্তিক-মুরতাদ’ ইত্যাদি নেতিবাচক অভিধায় ভুষিত করতো সমাজপতিরা। ঐ সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্ম ছিল বিভিন্ন অনুসঙ্গে। 

বেদ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, শঙ্করাচার্য, রামানুজ, কবীর, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, ব্রাক্ষধর্ম, আর্যসমাজ, মিশরের ধর্ম, নরওয়ের ধর্ম, জিউস-গ্রীস-রোমের ধর্ম, সুমেরু ধর্ম, ব্যাবিলনীয় ধর্ম, ইহুদী-তৌরাত-সিনাগোগ, খ্রীস্টান-বাইবেল-গির্জা-চার্চ, ইসলাম-কোরান-মসজিদ, পার্শী-জরথ্রুস্ট, কনফুসিয়াস-লাওৎজু-তাও, বৌদ্ধ-মঠ-ত্রিপিটক, মহাবীর, শিখ-গুরুনানক-গুরুদ্বার, মন্দির, গোম্পা, প্যাগোডা ইত্যাদি নানা শব্দ ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মানুষের জীবনে অসহায়ত্ব তথা মহামারী, দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামী, রোগ, অভাব, কষ্ট, বিফলতা ইত্যাদি ২০১৫ পূর্ববর্তী প্রাচীন পৃথিবীতে অনিরোধযোগ্য সমস্যার কারণে মানুষ তার অলৌলিক বিশ্বাসের উপর নিজেকে সমর্পন করে ধর্মের আশ্রয় চাইতো। ২০১৩ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল সভ্যতায় ধর্মের স্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা আমরা দেখবো ধারাবাহিকভাবে।

[ চলমান --- এর পর পর্ব-১৬ ]
[এটি একটি রূপক রচনা। যার মূল্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আজকের স্বার্থবাদী, সাংঘর্ষিক, বিপদজনক, অসহায়, অন্ধকারাচ্ছন্ন,হানাহানিপূর্ণ পৃথিবীর পরিবর্তে এক চমকপ্রদ, বিজ্ঞানময়, উন্নত, আলোকজ্জ্বল, শান্তির পৃথিবীর প্রত্যাশা। লেখকের জ্ঞানচক্ষু বলে, অবশ্যই একদিন এমন পৃথিবী প্রতিষ্ঠা হবে যা থাকবে রাজনৈতিক, ভাষিক ও ধর্মীয় বিভাজনমুক্ত। যেখানে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন থাকবে না, থাকবে না ইসরাইল ও মুসলিম নামে আলাদা দেশ। মানুষ মারণাস্ত্র উৎপাদন করবেনা মানুষেরই জন্য। তবে হতে পারে এটি হাজার বছর পরে কিংবা কিছুটা আগেই। কল্পিত লেখাটি সাজাতে গিয়ে লেখক চলে গেছেন ৩০১৩ সনের ঐতিহাসিকরূপে। তাদের চোখে দেখতে চেষ্টা করেছেন বর্তমান সময়ের কণ্টকপূর্ণ পৃথিবীকে। হাজার বছর ভবিষ্যতকালে গিয়ে ওখানে বসে বর্তমানকে অতীত বানানো কিছুটা কষ্টকল্পনা বৈকি! হয়তো লেখাটি অভিনব তথা নতুন চিন্তণের, যে কারণে মাঝে মধ্যে অযৌক্তিকতা চলে আসতে পারে কখনোবা! এ বিষয়ে মুক্তচিন্তাব্লগের বোধ্যা পাঠকের সুচিন্তিত সমালোচনা, মতামত, পরামর্শ প্রত্যাশা করি, যাতে পরবর্তী পর্বগুলো সংশোধিত হতে পারে প্রকাশের আগেই, ধন্যবাদ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন