সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার ইতিহাস পর্ব- ১৫ # ১১৭

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার ইতিহাস পর্ব-১৫
                              
ইহুদি তথা ইসরাইল জাতি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা এই যে, ইসরাইল একটি আগ্রাসী তথা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। আমারও ধারণা এমনই ছিল। এই কিউরিসিটি থেকে ইহুদি জাতি তথা ইসরাইল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি, যাতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে সহযোদ্ধা অনিমেষ রহমান। নানাবিধ বই-পুস্তক এবং বিশাল ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করে ইহুদি জাতির ইতিহাস জেনে বিষ্মিত হয়েছি। আজকের বিশ্বে তারা সন্ত্রাসী বা আগ্রাসী কিনা তা সচেতন পাঠক বিবেচনা করবে। নিজে বিভিন্ন উৎস থেকে ঐ জাতিটার যে ইতিহাস জানতে পেরেছি, তাই ধারাবাহিকভাবে দিলাম ১-১৭ পর্বে। ভিন্ন ভিন্ন সূত্র থেকে নানাবিধ তথ্য সংগ্রহের কারণে কোথাওবা ভিন্নতর তথ্য-কথামালা চলে আসতে পারে। এ ব্যাপারে সচেতন পাঠকের যৌক্তিক সংশোধনী ধন্যবাদের সঙ্গে গৃহীত হবে। ঈদের ছুটিতে ১০-দিনের অবকাশে যাচ্ছি বিধায় একসাথে ৬-১৭ পর্ব আগাম পোস্ট দিয়ে গেলাম, যাতে এ জটিল বিষয়গুলো আগ্রহী পাঠকরা ছুটির মধ্যে শেষ করতে পারেন। ধন্যবাদ পাঠকদের।                                  ।
আধুনিক অসাম্প্রদায়িক মানুষের দৃষ্টিতে ইহুদি জাতির ইতিহাস  [ পর্ব  ১৫ ]
 
একটি  জাতি গড়ে ওঠে নানা  ইতিহাসের ধারায়। এই ইতিহাস  সাধারণত  দীর্ঘায়িত হয়।  কিন্তু  ইসরাইলি ইহুদিদের ইতিহাস মোটেও দীর্ঘায়িত নয়। বর্তমান ইসরাইল  রাষ্ট্রের  উদ্ভব  হয়েছে  ইউরোপ  থেকে  আগত ইহুদিদের চেষ্টার ফলে। তারা ওই  অঞ্চলে  উপনিবেশিত হতে  আরম্ভ  করে  ১৮৯৭  সালের পর থেকে। উত্তর আফ্রিকায়  এবং  মধ্যপ্রাচ্যে  যেসব আরবি ভাষী  ইহুদি ছিল, তারা  চায়নি  কোনো  ইহুদি রাষ্ট্র গড়তে। বর্তমান বিশ্বে ইসরাইল একটা বড় সমস্যা। আর  তাকে  কেন্দ্র করে তৃতীয়  বিশ্বযুদ্ধ  হওয়া  অসম্ভব নয়। যাকে বলে জিওনিজম  তার উদ্ভব  হয়  ভিয়েনা শহরে। এখানে প্রথমে  থিওডর  হারজল  নামক  একজন ইহুদি সাংবাদিক ভিয়েনার ইহুদিদের নিয়ে শুরু করেন জিওনিস্ট  আন্দোলন। তিনি  ছিলেন একজন হাঙ্গেরীয় ইহুদি। সাংবাদিকতা  করতেন  জার্মান ভাষায়। তিনি দাবি  করেন, প্যালেস্টাইনে  ছিল ইহুদিদের আদি নিবাস। সব ইহুদিকে  সেখানে ফিরে যেতে  হবে, গড়তে হবে  ইহুদিদের  একটা  পৃথক স্বাধীন আবাসভূমি। এভাবেই  সূত্রপাত ঘটে  জিওনিস্ট আন্দোলনের।  সব ইহুদি  তখন এই আন্দোলনে সাড়া দেয়নি, কারণ তাদের কা ছে মনে হয়েছে,  এটা অসম্ভব। তখন প্যালেস্টাইন (ফিলিস্তিন)  ছিল তুরস্কের সুলতানের অধীনে একটি আধা স্বাধীন প্রদেশ। সেখানে ইহুদিদের  গিয়ে  একটা স্বাধীন  রাষ্ট্র গড়া  কার্যত অসম্ভব ছিল। তুরস্ক প্রথম  মহাযুদ্ধে পরাজিত  হওয়ার পর প্যালেস্টাইন  আসে ব্রিটেনের  নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে হতে পারে প্যালেস্টাইনে একটি  ইহুদি রাষ্ট্র  সৃষ্টির সুযোগ। 
কেইম  ওয়াইজম্যান  ছিলেন  একজন বিখ্যাত রসায়নবিদ এবং জিওনিস্ট নেতা যিনি জন্মেছিলে বর্তমান বেলারুশিয়ার রাজধানী মিন্সকের কাছে। শহরটি ছিল  ইহুদি প্রধান।  অধ্যাপনা  করতে  আসেন বিলাতের ম্যানচেস্টার  বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি  গবেষণা করতেন ব্যাকটেরিয়ার  গাজন প্রক্রিয়া নিয়ে। তিনি লক্ষ করেন  এক রকম ব্যাকটেরিয়া আছে যারা উৎপাদন করে এসিটন। এসিটন এক রকম জৈব বস্তু, যা করডাইট  নামক  বিস্ফোরক  তৈরির কাজে লাগে। প্রথম মহাযুদ্ধের  সময়  বিলাতে  এসিটনের  দারুণ অভাব দেখা দেয়। ওয়াইজম্যান  ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, তিনি অনেক এসিটন উৎপাদন  করতে পারবেন। ব্রিটিশ সরকারকে  তিনি   কাজে সাহায্য সহযোগিতা  করতে রাজি। কিন্তু একটি বিশেষ শর্তে আর তা হলো,  যুদ্ধে জিতলে  প্যালেস্টাইনে গড়তে দিতে হবে  ইহুদিদের আবাস ভূমি। প্রথম  মহাযুদ্ধে  তুর্কিরা হারার পর প্যালেস্টাইন  আসে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। আর বহু ইহুদি ইউরোপ থেকে গিয়ে সেখানে  আরম্ভ করে উপনিবেশিত হতে। তারা কিনতে  শুরু করে প্যালেস্টাইনের  জলাভূমি অঞ্চল অনেক মূল্যে। প্যালেস্টাইনের  মুসলমান আরবরা ধনী  হওয়ার  লক্ষ্যে বিক্রি করতে শুরু করে এসব জলাভূমি। ইহুদিরা  এসব  জলাভূমি সেচে বের করে  আবাদি ভূমি।  রকম একটি জলা জায়গা তারা সেচে গড়ে তেলআবিব  শহর। তেলআবিবে  তারা স্থাপন করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে  পড়াশোনা শুরু হয় হিব্রু ভাষার মাধ্যমে। এই হিব্রু  ভাষা সৃষ্টি  করা হয় পুরনো মৃত হিব্রু ভা ষাকে সংস্কার করে। এই ভাষা লাভ করেছে একটি শক্তিশালী রূপ। একটি মৃত ভাষাকে  এরকম আধুনিক ভাষাতে  পরিণত  করা ইহুদিদের একটা বড় কৃতিত্ব। আরবরা  ঝতেই পারেননি,  ইহুদিরা আসলে  প্যালেস্টাইনে কেন আসছে, আর কী তাদের লক্ষ্য। 
প্যালেস্টাইনের  আরবরা ছিল শিক্ষা দীক্ষায় খুবই পিছিয়ে। পিছিয়ে  ছিল প্রযুক্তিতে। ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদের সাথে কোনো ভাবেই  তাদের তুলনা  চলে না। ইহুদিদের প্রকৃত  অভিপ্রায়  আরবরা বুঝতে পারে অনেক পরে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জার্মানিতে  হিটলার ক্ষমতা  লাভের পর  আরম্ভ করেন ইহুদি বিতাড়ন। জার্মান ইহুদিরা  ১৯৩৫ সাল  থেকে দলে দলে এসে উপনিবেশিত হতে থাকে প্যালেস্টাইনে। আরবরা প্রতিবাদ তোলে। ব্রিটিশ প্রশাসন একপর্যায়ে বাধ্য হয় এভাবে  ইহুদি  উপনিবেশ গড়া বন্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে জেতার জন্য ইংরেজদের  নিতে হয়  ইহুদিদের সাহায্য সহযোগিতা। ইহুদিরা  প্যালেস্টাইনে যুদ্ধে সহযোগিতার নামে গড়ে তুলতে থাকে  নিজস্ব সেনাবাহিনী। আরবরা সেটা করতে চায়নি।  কারণ বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি তখন হয়ে উঠেছিল খুবই  অনিশ্চিত। প্যালেস্টাইনে আরবরা  ভাবতে পারছিল না কী তাদের করণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়  বিশ্ববিখ্যাত  ইহুদি বিজ্ঞানী, জার্মান থেকে  বিতাড়িত  আলবার্ট আইনস্টাইন  আগস্ট ১৯৩৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট  ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিতে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন  পরমাণু বোমা তৈরির জন্য  অর্থ বরাদ্দ  করতে। রুজভেল্ট  আইনস্টাইনের সুপারিশে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেন,  যা না হলে  পরমাণু বোমা  তৈরি হতো বলে মনে হয় না। পরমাণু বোমা তৈরির কাজে যারা অংশ নেন তারা  বেশির ভাগই  ছিলেন ইহুদি বিজ্ঞানী। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মারা যান ১২ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে। পরমাণু বোমা তৈরি  তখন শেষ হওয়ার পথে।  ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান প্রেসিডেন্ট হন। তিনি সদ্য তৈরি  পরমাণু বোমা  নিক্ষেপের হুকুম  দেন যুদ্ধরত জাপানের  ওপর ৬ আগস্ট,  ১৯৪৫  সালে প্রথমে জাপানের  হিরোশিমা শহরে ফেলা হয় পারমাণবিক বোমা। এর তিন দিন পর ফেলা হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে। যুক্তরাষ্ট্র জাপানে পরমাণু বোমা ফেলেছিল ইহুদি উপদেষ্টাদের বুদ্ধিতে।  সময় ইহুদি উপদেষ্টারা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে হয়ে ওঠেন খুবই প্রভাবশালী। জাপানে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে ট্রুম্যান ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে অনুরোধ করেন ইউরোপের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত ১-লাখ ইহুদিকে প্যালেস্টাইনে যেতে দিতে। পরিস্থিতি এর ফলে ইহুদিদের আরো অনুকূল হয়। প্রধানত মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ১৪ মে,  ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভোটের মাধ্যমে পাস হয় সাবেক প্যালেস্টাইনকে বিভক্ত করে ইসরাইল নামে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ২ নভেম্বর আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান। 
নিউইয়র্ক  ইলিনয়েসের ইহুদিদের সমর্থনে তিনি অনেক সহজেই নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর প্রেসিডেন্ট হন কেইম ওয়াইজম্যান। তার অক্লান্ত চেষ্টা  কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সাবেক প্যালেস্টাইনে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ থেকে গিয়ে উপনিবেশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। বর্তমান ইসরাইল সৃষ্টি হয়েছে অত্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে। এভাবে রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।
ইউরোপে ইহুদিদের মধ্যে দুটি বিভাগ লক্ষ করা যেত। এর একটিকে বলা হতো পশ্চিমের ইহুদি আর অপরটিকে বলা হতো পুবের ইহুদি এই পুবের ইহুদিদের মধ্যে পড়ত তখনকার রাশিয়া, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার ইহুদিরা। পশ্চিমের ইহুদিদের দেখে ইহুদি বলে শনাক্ত করা যেত না। এরা যেসব দেশে বাস করত সেসব দেশের ভাষাতেই কথা বলত নিজেদের মধ্যে।এরা আচার আচরণে প্রত্যেকে হয়ে উঠেছিল সেসব দেশের অন্যান্য মানুষেরই মতো। কিন্তু পুবের ইহুদিরা পরত বিশেষ ধরনের জামা-কাপড়। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলত  সাহিত্যচর্চা করত একটা বিশেষ ভাষায়। যাকে বলা হতো ইদিশ। এই ভাষা গড়ে উঠেছিল জার্মান  হিব্রু ভাষার সমন্বয়ে। এটা লেখা হতো হিব্রু অক্ষরে। অনেকে মনে করত ইদিশ হবে ভাবী ইসরাইলের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সেটা হয়নি। বর্তমান ইসরাইলে পশ্চিম থেকে যাওয়া ইহুদিদের সাথে পুবের ইহুদিদের খাপ খেয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ঘটছে বিরোধ;  বিশেষ করে রাশিয়া থেকে যাওয়া ইহুদিদের সাথে তারা ভিন্ন পল্লী গঠন করে আলাদাভাবে বাস করতে যাচ্ছে।
 
এরপর পর্ব  ১৬
(এ পর্ব ভালভাবে বোঝার জন্য আগের পর্বগুলো পড়া আবশ্যক)
লেখকের ফেসবুক ঠিকানা : https://www.facebook.com/DrLogicalBangal

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন