সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

২০১৫ সন পূর্ববর্তী পৃথিবীর মানুষের ভাষা ব্যবহার - ৩ # ১৩০

৩০১৫ খ্রিস্টাব্দের ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে ২০১৫ সন পূর্ববর্তী পৃথিবীর মানুষের ইতিহাস : পর্ব - ৮
২০১৫ সন পূর্ববর্তী পৃথিবীর মানুষের ভাষা ব্যবহার -  

২০১৩ সনে সময়ের ভাষা আদান-প্রদানকারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ‘মিথ্যা’ বলা ও শোনা। ‘মিথ্যা’ মানে হচ্ছে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে বিকৃত বা অসত্য কিছু উপস্থাপন বা প্রেরণ করা। ঐ সময়ের মানুষেরা সরাসরি কিংবা সেলফোনে ভাষা ব্যবহারের সময় প্রায়ই এই মিথ্যাটি ব্যবহার করতো যত্রতত্র বিশেষ করে বাংলাদেশ অঞ্চলটির মানুষেরা। বর্তমান সময়ের মত ঐ সময়ের মানুষ প্রযুক্তিতে এতো উন্নত না হওয়ার কারণে, মুখে বলা কথার সঙ্গে ব্রেন-হৃদয়ে গ্রথিত কথার পার্থক্য বুঝতে পারতো না। এটি সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। যে কারণে নানা মানুষ নানাভাবে ‘প্রতারিত’ হতো। যেমন ভাষার বক্তা শ্রোতার উদ্দেশ্যে বললো যে, শ্রোতার পাওনা ‘বিনিময় কোড’ (যাকে প্রাক্তন বাংলাদেশ অঞ্চলে ‘টাকা’ এবং আমেরিকা অঞ্চলে ‘ডলার’ বলা হতো) সে তাকে আগামীকাল দুপুর ১২.০০টায় ‘মতিঝিল’ নামক স্থানে পরিশোধ করবে কিন্তু বক্তার এ বক্তব্যটি থাকতো মিথ্যা, যা বক্তা নিজে জানলেও শ্রোতা তা বুঝতে পারতো না বর্তমান সময়ের মত বক্তার মন আগাম পড়তে না পারার কারণে। কিংবা ঐ সময়ের রীতি অনুযায়ী ‘বৈধ’ যৌনজীবন যাপনের লাইসেন্সধারী যাদেরকে ‘দম্পতি’ বলা হতো, তাদের একজন লাইসেন্সহীন অন্য কারো সাথে ‘অবৈধ’ সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে বিশেষ কোন গোপন স্থানে গমন করলেও, তার লাইসেন্সধারী পার্টনার তা খুব একটা ধরতে পারতো না বর্ণিত ‘মিথ্যা ভাষা’ ব্যবহারের দক্ষতার কারণে, যা বর্তমান মানুষ ব্যবহার করতে পারে না কিংবা করে না ‘মিথ্যা’ বিলুপ্ত হওয়ার কারণে। এ মিথ্যা ভাষা ব্যবহারে ঐ সময়ের মানুষ এতোই দক্ষ ছিল যে, ঐ সময়ের বিচার আদালতে গিয়ে কয়েকজন মিথ্যুক একজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিয়ে দিতে পারতো কিংবা দোষীকে মিথ্যা বলে মুক্তও করতো অবলীলায়। বিচারকগণ সত্য-মিথ্যা কিছুই পাঠ করতে পারতো না বিধায়, কখনো নির্দোষকে শাস্তি দিতো কিংবা মুক্ত করে দিতো প্রকৃত দোষীকে। কারণ ঐ সময়ের বিচারকগণও ছিল ভাষা ব্যবহার দক্ষতায় নিতান্তই অন্যান্য সাধারণের মতই ‘নির্বোধ’। যে কারণে নিম্ন আদালতের বিচারকের রায় উচ্চ আদালতে নানাবিধ ‘কূট ভাষা প্রয়োগের কারণে’ পাল্টে যেত, আবার সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে কখনো অন্যরূপ হয়ে যেত রায়, সবই ছিল ভাষা প্রয়োগের খেলা। কেবল ভাষাগত দুবর্লতার কারণে এভাবে ঐ সময়ের বিচার ব্যবস্থাও ছিল হাস্যকর, যা বিস্তারিত আমরা জানবো ২০১৩ সন পূর্ববর্তী পৃথিবীর বিচার ব্যবস্থা ও শাস্তি অধ্যায়ে।

ঐ সময় মানুষ জন্ম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ নয় মাস যার ‘জঠরে’ পূর্ণতা প্রাপ্তি পেত তাকে বাংলাভাষীরা বলতো ‘মা’, আসলে মা বলতে বর্তমান সময়ে মানুষ তৈরীর ‘ধীর প্রক্রিয়ার একটি মেশিন’ বলা যেতে পারে। মা ছিল অন্যান্য জাতি ও বাঙালির কাছেও পরম শ্রদ্ধেয় নারী শ্রেণির মানুষ, পুরুষরা কখনো ‘মা’ হতে পারতো না। বিশ্বের প্রায় সকল মানুষ ও প্রাণিই ‘মা’কে কম-বেশী ভালবাসতো। পোলিস ও বেলারুশের অধিবাসীরা মাকে ‘মটকা’ বললেও, বাঙালির কাছে ‘মটকা’ ছিল একটি বড় মাটির পাত্রের নাম। আবার বিলুপ্ত লাংলা, সার্ডিনিয়ান, স্লোভাক ও শাহিলি ভাষায় মাকে ‘মামা’ বলা হলেও, বাঙালিরা ‘মামা’ বলতে ‘মায়ের ভাই’কে বোঝাতো। কি অবাক করা ভাষা ছিল ২০১৩ সনে তাই না? 

আবার কোন কোন ভাষায় একটি শব্দের যে অর্থ প্রকাশ পেতো অন্য ভাষায় তার অর্থ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন ‘বার’ বলতে ইংরেজি ভাষীরা প্রতিবন্ধক, বাঁধা কিংবা ‘পানশালা’ বোঝালেও, বাঙালিরা সপ্তাহের বিশেষ দিনকে বলতো ‘বার’ যেমন সোমবার। আবার ‘জামাল’ ছিল বাঙালি জাতির মানুষের নাম কিন্তু আরবি ভাষীরা জামাল বলেতে ‘উট’ নামক এক প্রকার গৃহপালিত প্রাণি বোঝাতো, যার পিঠটি ছিল বেশ বাঁকা ও উঁচু, যাকে বাঙালিরা বলতো উট। একইভাবে বাংলাভাষীরা তাদের ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনি ‘ক’ এভাবে লিখলেও, ইংরেজি ভাষীরা লিখতো K, আর আরবি ভাষীদের ‘ক’ ছিল ‘ك’, আবার বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনি ‘৫’ এভাবে লিখলেও, ইংরেজি ভাষীরা লিখতো 5, আর আরবি ভাষীদের পাঁচের চেহারা ছিল ‘٥’, বাঙালিরা যাকে বলতো ‘পাঁচ, ইংরেজি ভাষীরা ‘ফাইভ’ এবং আরবিরা ‘খামছা’।

ঐ সময়ের ভাষা ব্যবহারে যেহেতু শব্দ সৃষ্টি করতো হতো, তাই অনেকে বাকযন্ত্রের ত্রুটির কারণে ভাষা ব্যবহার করতে পারতো না। যেমন ‘টাং’ বা ‘জিহবা’ না থাকলে কোন ধ্বনিই উচ্চারণ করা যেত না, আবার ঠোঁট না থাকলে ‘প-ম’ শ্রেণির ধ্বনি উচ্চারণ করা যেতনা। যারা এভাবে ধ্বনি উচ্চারণ তথা ভাষা প্রয়োগে অপারগ হতো তাদেরকে সমাজে ‘বোবা’ বলা হতো। এদের কেউ কেউ ইশারায় কিছু কিছু ভাষা প্রয়োগ করতে পারতো। আজকের একত্রিশ শতকের বিশ্বের সকল মানুষ ও নিকটবর্তী অন্য গ্রহের অধিবাসীদের কাছে সর্বজনবোধ্য একটি মাত্র ভাষা ও তার সিমবোলিক প্রতীক গৃহীত হতে সময় লেগেছে প্রাচীন পৃথিবীর অন্তত ৯০০ বছর, আজকের সময়ের হিসেবে যা বিস্ময়কর! এই সময় মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞানে নানা উৎকর্ষতা লাভ করে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার কারণে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ও মানুষে মানুষে হানাহানির ভুল পথ চলা বুঝতে পেরে প্রাচীন রাষ্ট্র বিভাজন, ভাষিক বিভাজন, ধর্ম ও বর্ণ বিভাজন ইত্যাদি তুলে দেয় এবং বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও ভাষাকে বিলুপ্ত করে সকল মানুষের জন্যে মাত্র ‘একটি পৃথিবী’ ও তার সর্বজনবোধ্য ‘একটি ভাষা’ ব্যবহারের আধুনিক ধারা প্রণয়ন করে। যে কারণে আজকের মানুষকে একে অন্যের কথা বোঝার জন্যে ‘ডিকশনারী’ নামক প্রাচীন ‘মহাগ্রন্থ’ ব্যবহার করতে হয়না কিংবা অন্য অঞ্চলে যেতে ব্যবহার করতে হয়না পাসপোর্ট-ভিসা নামক ‘হাস্যকর কাগজপত্র’। যা বর্তমান সময়ের মানুষ চিন্তা করলে তাদের কাছে একুশ শতক ও এর পূর্ববর্তী মানুষের ভাষা ব্যবহার ও তাদের বিচিত্র নেতিবাচক কণ্টকাকীর্ণ জীবনধারা কতই না বিস্ময়কর তথা প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়! যা ঐ সময়ের কোটি কোটি মননশীল মানুষেরা মৃত্যুর কাছে হার মানার কারণে দেখে যেতে পারলো না যে, ৩০১৩ সালের ভয়েস সিনথেসাইজার অনুধাবনকারী, লিকুইড হিলিয়াম আর টাইটেনিয়াম সমৃদ্ধ আজকের পৃথিবী, ২০১৩ সনের তুলনায় কতই না নিরাপদ, কল্যাণকর ও বাসযোগ্য বিশ্বের সকল মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণির জন্যে!    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন