রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মিসরিয় ‘নারী ফারাও’ নেফারতিতি [মিসেস আখেনাতেন] # ৯৫

মিসরিয় ‘নারী ফারাও’ নেফারতিতি [মিসেস আখেনাতেন]
যিনি বহুদেবতাবাদ থেকে একেশ্বরবাদের প্রবর্তক মিসরে !

প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় বিখ্যাত রানীদের মধ্যে নেফারতিতি ছিলেন সেরা। তিনি ছিলেন ফারাও আখেনাতেনের স্ত্রী। মিসরীয়দের ধর্মীয় আচরণে আখেনাতেন যে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন, তাতে নেফারতিতিরও সহযোগিতা ছিল চমকপ্রদ। মিসরীয় সভ্যতার প্রধান দেবতা হিসেবে আমরা সূর্যকে জানলেও, আগে মিসরে বহু দেবতা পূজা করার প্রচলন ছিল। আখেনাতেনও নেফারতিতির উদ্যোগেই মিসরীয়রা সূর্যকে একমাত্র দেবতা হিসেবে পূজা করতে শুরু করে। অর্থাৎ মিসরে বহু দেবতার বদলে এক ঈশ্বরের পূজা প্রচলিত হয়। তবে নেফারতিতি অন্য দেবতাদেরও শ্রদ্ধা করতেন। প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসে নেফারতিতিকে খুশি, আনন্দ বা ভালোবাসার প্রতিক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।

এক মহাপরাক্রমশালি সভ্যতা আর ধর্ম ছিল মিসরে। শাসক বা ফারাওরা (ফেরাউন) ছিল ঈশ্বরের সরাসরি প্রতিরূপ। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় সভ্যতা হচ্ছে মিসরীয় সভ্যতা। আর সেই রহস্যে ঘেরা সভ্যতার সবচেয়ে সুন্দরী রানী মনে করা হয় নেফারতিতিকে। বলা হয় জগদ্বিখ্যাত ক্লিওপেট্রার চেয়েও সুন্দরী ছিলেন তিনি। আর তার স্বামী আখেনাতেনকে নিয়ে বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী মিসরীয়দের মধ্যে প্রথম একেশ্বরবাদ ধারণার প্রচলন করেন তিনি। আখেনাতেনের সঙ্গে নেফারতিতির প্রেম, তার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার সর্বোপরি তার সৌন্দর্য এখনো অনেক রহস্যের কারণ।

মিসর তো বটেই, গোটা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সুন্দরীদের একজন মানা হয় নেফারতিতিকে। আর মিসরীয় সভ্যতার 'সিগনেচার' বা চিহ্ন হিসেবে পিরামিড আর মমির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এই সুন্দরীরর আবক্ষমূর্তির ছবি বা প্রতিলিপি। এই ফারাও সম্রাজ্ঞীর প্রহলিকাময় আবক্ষমূর্তিটি সারাবিশ্বে প্রচণ্ড জনপ্রিয় এবং আগ্রহের বিষয়। মিসরের ফারাও সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে এমনকি তখনকার মিসরবাসীদের মধ্যেও তার রূপ ছিল কিংবদন্তির মতো। যিশুখ্রিস্ট জন্মেরও ১৩৭০ থেকে ১৩৩০ বছর আগ পর্যন্ত নেফারতিতির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গেছে। আর ঠিক এরপর থেকেই মিসরের সব ঐতিহাসিক দলিল, দস্তাবেজ থেকে তার নাম মুছে ফেলা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্রে তার আর কোনো চিহ্ন রক্ষিত হয়নি, যেমন রক্ষিত রয়েছে অন্যান্য ফারাও আর তাদের সম্রাজ্ঞীদের স্মৃতি। নেফারতিতি নামের অর্থ হলো সুন্দর আসছে। নেফারতিতি বিয়ে করেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের সন্তান আখেনাতেনকে, যিনি পরবর্তী ফারাও হিসেবে রাজত্ব করেন চতুর্থ আমেনহোটেপ হিসেবে। তিনি ছিলেন মিসরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও। তার সঙ্গে একাত্ম হয়েই মিসর শাসন করেন নেফারতিতি। ধারণা করা হয় নেফারতিতি ও আখেনাতেনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না যা সাধারণত মিসরীয় ফারাওদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। নেফারতিতির জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি বলেই তিনি এত রহস্যের কারণ। তবে ধারণা করা হয়, তিনি রাজবংশের একজন ছিলেন। তিনি ঠিক কোথায় জন্মেছিলেন এখনো সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারও কারও মতে, তিনি আখমিম শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি মিসরের বাইরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বেশির ভাগ মত হলো, নেফারতিতি ছিলেন আয়-এর কন্যা। আয় ছিলেন ফারাওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি তিন-তিনজন ফারাওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং ধরা হয় তিনি ফারাও তুতেনখামেনের রাজ্যের অন্যতম শক্তি ছিলেন। এই তুতেনখামেন হলেন নেফারতিতির সৎ ছেলে। আর পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র তার মমি বা সমাধিই অবিকৃত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। আর এই মমির অভিশাপে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় যেটি ইতিহাসে তুতেনখামেনের মমির অভিশাপ নামে বিখ্যাত।

বহু ঈশ্বরের ধারা ভেঙে দেওয়া সেই সময়ের মিসরে সহজ কাজ ছিল না। শক্তিশালী পুরোহিতদের বিরোধিতা এবং জনগণের আপত্তির মুখেও এই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন আখেনাতেন। কিন্তু তার একার পক্ষে সব করা সম্ভব ছিল না। তার স্ত্রী নেফারতিতি সবসময় তার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার কারও কারও মতে, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন নেফারতিতিই। নতুন ধর্মমতে আমূল বদলে গেল মিসরীয়দের জীবনধারা। প্রথমত আমেনহোটেপ তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন, আখেনাতেন। আখেনাতেন মানে হচ্ছে আতেনের পুত্র। আতেন [সূর্য দেবতা] এর উপাসনার ধরন একটু অন্যরকম ছিল। এই দেবতার উপাসনা দিনের আলোতে বাইরে সবার সামনে হতো। এর আগে আমুনরার পুরোহিতরা অন্ধকার মন্দিরগুলোর ভেতরে রহস্যময় কায়দায় করতেন। সাধারণ মানুষের সেই উপাসনার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ থাকত না। নতুন দেবতা এবং নতুন উপাসনার ফলে সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণের মাঝে শুধু একটি সত্তাই রয়ে গেল। তিনি হলেন ফারাও আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন স্বয়ং। ফলে পুরোহিতদের গুরুত্ব চরমভাবে হ্রাস পেল। উপাসনার জন্য দেবতাকে উৎসর্গের জন্য পুরোহিতরা যে অর্থ জনগণ থেকে নিতেন, সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, আখেনাতেন হুকুম দিলেন কার্নাকের মন্দিরের সব জৌলুস সরিয়ে দিতে। সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে তার আদেশে আমুন-রা এবং অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা হলো। থেকে গেল শুধু এক ঈশ্বর আতেন বা সূর্য। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকল পুরোহিতদের ক্ষোভ। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না আখেনাতেনের। খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারলেন না তিনি। সূর্য দেবতার শহরের কাজ শেষ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। এরপরই ঘটে সেই অবিস্মরণীয় পরিবর্তন। মিসরের ফারাও হন নেফারতিতি। নেফারতিতির তত্ত্বাবধানে আতেন দেবতার আখেনাতেন শহরের কাজ আরও জোরেশোরে শুরু হয়। এর মধ্যেই নেফারতিতির মৃত্যু হয়। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কোনো ছেলে ছিল না, ছিল ছয় মেয়ে। তাই নেফারতিতির মৃত্যুর পর পুরোহিতরা আখেনাতেনের অন্য রানীর আট বছর বয়সী ছোট ছেলে তুতেনখামেনকে মিসরের ফারাও নির্বাচন করেন। বালক তুতেনখামেনকে সিংহাসনে বসিয়ে, পুরোহিতরা সমগ্র মিসরকে আগের অবস্থায় নিয়ে যান। আখেনাতেন শহরের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, আবার পুরোদমে উপাসনা শুরু হয় কার্নাকের মন্দিরে। সূর্য দেবতা আতেনের বিদায় হয় এবং আবার শুরু হয় দেবতা আমুন-রা এবং অন্যসব দেবদেবীদের উপাসনা।

ফারাওরা মিসরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে শাসন করতেন। তাদের ছিল অনেক দেবদেবী, অর্থাৎ তারা বহু ইশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ফারাওয়ের পরই ছিল শক্তিশালী পুরোহিত গোষ্ঠী। মূলত এদের দ্বারাই শাসিত হতো মিসর। তারা নানা দেবদেবীর উপাসনা করতেন। মন্দিরগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত। জনগণ এবং ঈশ্বরের মাঝে থাকতেন শুধু ফারাও এবং তার পুরোহিতবাহিনী। এই বহু ঈশ্বরবাদে পরিবর্তন আসে নেফারতিতি-আখেনাতেনের সময়। তখন মিসরে নানা দেবদেবী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা আমুন-রা এর উপাসনা হতো। কার্নাকের মন্দির ছিল প্রধান উপাসনালয়। আমেনহোটেপ [আখেনাতেন] আমুন-রাকে দেবতা হিসেবে অস্বীকার করেন এবং অন্যসব দেবদেবীকেও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়ে আসেন নতুন সৃষ্টিকর্তা আতেনের ধারণা। মিসরের এটাই প্রথম এলো একেশ্বরবাদী চিন্তাধারা। আতেন মূলত সূর্য দেবতা। আমেনহোটেপ একমাত্র দেবতা আতেনের উপাসনা করতেন। তখনই তার নাম পাল্টে আখেনাতেন হয়। এক্ষেত্রে তার স্ত্রী নেফারতিতিও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তারা দুজনে মিলে সূর্য পূজার নতুন ধর্মের প্রচলন করেন এবং তারা দুজন ছিলেন এই ধর্মের কাণ্ডারি। তাদের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ সূর্য দেবতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত। তারা একটি শহরও প্রতিষ্ঠা করেন এই সূর্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই শহরে খোলা আকাশের নিচে এখনো কিছু সূর্য দেবের উপাসনালয় আছে।

জন্ম বা বংশ বৃত্তান্ত যা-ই থাক তিনি যে সুন্দরী হিসেবে কিংবদন্তি ছিলেন তাতে দ্বিমত ছিল না কারও। পুরুষকে নাচানো তো বটেই রাজ্য শাসন এবং কূটনীতিতেও অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন নেফারতিতি। ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার তুলনা চলে না, কারণ নেফারতিতি ছিলেন ক্লিওপেট্রার চেয়েও প্রায় দেড় হাজার বছর আগের রানী। তবুও ইতিহাস দুজনকে একবিন্দুতে দাঁড় করালে বারবার নেফারতিতির দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে। কারণ ইতিহাসের প্রথম নারী ফারাও, ধর্ম সংস্কার, আখেনাতেনের প্রতি ভালোবাসা আর সর্বোপরি মোহনীয় সৌন্দর্যের কারণে অধিকাংশ দিক থেকেই ক্লিওপেট্রাকে হারিয়ে দিয়েছেন নেফারতিতি। জীবৎকালে মিসরের রাজনীতির জটিল পাশাখেলার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন নেফারতিতি। ফারাও আখেনাতেনের প্রধান স্ত্রী হয়ে মিসরের বহু ঈশ্বরবাদী ধর্মচেতনা থেকে একেশ্বরবাদী ধর্মের দিকে প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন নেফারতিতি। প্রাচীন হায়োরিগি্লফিতে তাকে বলা হতো উত্তরাধিকারিণী, মধুরতার দয়িতা, মধুভাষিণী। নেফারতিতি মানে দুই ভূখণ্ডের নারী। মিসরের উচ্চ ও নিম্নভূমির প্রিয় পাত্রী ছিলেন বলেই সম্ভবত তাকে এটা বলা হতো। অনেকেই বিশ্বাস করেন, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর এবং তুতেনখামেনের সিংহাসন আরোহণের আগে তিনি মিসর শাসন করেছিলেন। আর এসব কিছুই আসলে নেফারতিতিকে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে। বার্লিনের নিউইস জাদুঘরে রাখা নেফারতিতির মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন ভাস্কর ‘থুটমোস’। এই মূর্তিটি থেকে সে যুগের মিসরের শিল্পকলা সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানিয়ে দেয় বিশ্ববাসিকে।

বিস্ময়কর ব্যাপার পৃথিবীতে কেউই এখন আর মিসরীয় ধর্ম বিশ্বাস করেনা। এক সময় যে ধর্মের দাপট কেবল আফ্রিকাতেই ছিলনা, তা দাপিয়ে বেড়াতো গোটা বিশ্বটাকে।

(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট ও বাংলাদেশ প্রতিদিন)

1 টি মন্তব্য:

  1. আমি জানিনা সেই যুগের এসব ইতিহাস কতখানি সত্য। অনেক ঐতিহাসিকও প্রাচীন ইতিহাসের শত শত বছরের এমন বয়ান দেন যেন, তিনি ঐ সময় জীবিত ছিলেন এবং তার চোখের সামনেই সব কিছু ঘটেছে।

    উত্তরমুছুন