রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতি কি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার রাখে? [ পর্ব – ৩ ] # ১০৫

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতির ইতিহাস পর্ব-৩

৩০১৫ সনের ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে ২০১৫ পূর্ববর্তী পৃথিবীর পৃথিবীর ইতিহাস
২০১৫ সনের প্রায় ৫০০০ বছর আগে সুমেরু দেশের উর শহরে আব্রাম নামে এক লোক বাস করতেন, যাকে ইহুদীরা তাদের ‘জাতির পিতা’ ও নবী মনে করতো। তিনি আদেশ পেলেন যে, স্রষ্টা তথা ‘যিহোবা’কে মেনে চললে ‘যিহোবা’ তাদের এমন এক দেশ উপহার দিবেন, যেখানে শান্তি-ই শান্তি! আব্রাম বা পরবর্তীতে আব্রাহাম তার জাতি তথা ইহুদীদের কল্যাণের জন্যে যেহোবার সাথে এভাবে এক ‘চুক্তির’ মাধ্যমে যে ‘শান্তির দেশে’ তার জাতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘কেনান’ (প্যালেস্টাইন-ইসরাইল)।


২০১৫ সনের পূর্ববর্তী প্রাচীন পৃথিবীতে Judaism ছিল ইহুদী ধর্মের প্রতিশব্দ, যারা ছিলো বিশ্বের প্রাচীনতম জাতি ও ধর্মধারী। ‘যিহোবা’কে তারা বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা মনে করতো। যিহোবার অন্য নাম ছিল ‘‘ইয়াহওয়া, যোহেভান, ইলোহিম, শেখিনা, মাকোম’’ ইত্যাদি। এটি আব্রাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও মোজেস কর্তৃক প্রবর্তিত বিশ্বের প্রথম কিংবা প্রধানতম একেশ্বরবাদী ধর্ম ছিল। ইহুদীরা পৃথিবীর সর্বত্র বসবাস করতো প্রাচীনকাল থেকেই। যখন যেখানের যে ধর্ম তাই তারা অনুসরণ করতো। ব্যাবিলনে থাকাকালীন ব্যাবিলনের ধর্ম, আবার মিশরে বসবাসের সময় মিশরীয় ফারাওদের ধর্ম মানতো ইহুদীরা। ২০১৩ সনের প্রায় ৫০০০ বছর আগে সুমেরু দেশের উর শহরে আব্রাম নামে এক লোক বাস করতো, যাকে ইহুদীরা তাদের ‘জাতির পিতা’ ও নবী মনে করতো। তিনি আদেশ পেলেন যে, স্রষ্টা তথা ‘যিহোবা’কে মেনে চললে ‘যিহোবা’ তাদের এমন এক দেশ উপহার দিবেন, যেখানে শান্তি-ই শান্তি! আব্রাম বা পরবর্তীতে আব্রাহাম তার জাতি তথা ইহুদীদের কল্যাণের জন্যে যেহোবার সাথে এভাবে এক ‘চুক্তির’ মাধ্যমে যে ‘শান্তির দেশে’ তার জাতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘কেনান’ (প্যালেস্টাইন)। ইহুদীদের প্রথম মন্দিরে নুহের জাহাজ, কল্পিত ‘চিরুবিম’ পশুর মূর্তি ছিল। ‘চিরুবিম’ ছিল আকাশে ভাসমান উড়ন্ত এ্যাঞ্জেল, যাতে উপবেশন করতো ‘যিহোবা’ নিজে। ইহুদীরা তাদের প্রার্থনালয়ে ‘যিহোবা’র কোন মূর্তি রাখতো না কেবল তার পুজো করতো। আবার তারা ‘যিহোবা’ কে ভুলে গিয়ে বেল, মার্ডুক ইত্যাদি দেবতার পুজোও শুরু করে দিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। পূজা থেকে বাদ পড়ার কারণে ‘যিহোবা’ তাই রেগে তাদের শাস্তি দেন কখনো কখনো। পর্যায়ক্রমে তাদের উপর বিশেষ প্রতিনিধি বা নবী ধারাবাহিকভাবে প্রেরণ শুরু করে ইহুদীদেরকে ‘যিহোবা’র পথে আনা ও ধরে রাখার জন্যে।

এরূপ অনেক প্রেরিত প্রতিনিধির মধ্যে বিশেষ একজন ছিলেন নবী ‘মোজেস’ যাকে ২০১৩ সনের মুসলমানরা ‘মুসা’ বলতো। ‘যিহোবা’ ইহুদীদের মিশর থেকে ‘নিজস্ব দেশ কেনানে’ নিয়ে যাওয়ার জন্যে ‘মোজেস’কে একটি পাহাড়ে বিদ্যুতের অক্ষরে লিখে ১০-টি নির্দেশনা দেন। যেগুলো ইহুদীরা 10-commandments হিসেবে খুবই মান্য করতো। এই ১০টি নির্দেশনা ছিল ‘‘যিহোবার উপাসনা করা, যিহোবায় বিশ্বাস, মূর্তি না বানানো বা মূর্তিপূজা না করা, মা-বাবাকে শ্রদ্ধা, প্রাণি হত্যা না করা, নারী-পুরুষে অবৈধ সম্পর্ক না করা, চুরি না করা, প্রাপ্যতা ছাড়া না নেয়া, মিথ্যা স্বাক্ষী না দেয়া এবং চাকর, পশু ও প্রতিবেশীকে অত্যাচার না করা’’। এ ছাড়া এ ধর্মের নানাবিধ কথা লেখা ছিল তাদের পুরণো ‘তালমুদ’ পুস্তকে। হিব্রু ভাষায় লেখা ‘তাওরাত’ ছিল তাদের ঐশ্বরিক কিতাব, যা পরবর্তীতে ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বা বাইবেলে রূপান্তর ঘটে। ইহুদীদের মতে, সিনাই পাহাড়ে তৌরাতের আদি পাঁচ পুস্তক ‘যিহোবা’ বা স্রষ্টা নিজহাতে ‘মোজেস’কে দিয়েছিলেন। তৌরাত আবার ‘হলাকখা’ ও ‘হাগগাদা’ নামে বিভক্ত ছিল।

‘সিনাগোগ’ ছিল ইহুদীদের পবিত্র প্রার্থনাগৃহ। এরা সপ্তাহে শনিবার কর্মবিরতি বা ছুটি কাটাতো ও প্রার্থনা করতো। এটি ছিল একটি চরমপন্থী ধর্ম। এ ধর্মে কেউ ধর্মান্তরিত কিংবা ধর্মত্যাগ করতে পারতো না। তাদের মতে, মানুষ যিহোবা বা স্রষ্টার আকৃতিতে সৃষ্টি। ইহুদীরা যাযাবর ও প্রাচীন ব্যাবিলন ও হাররো সেমিটিক জাতির মত জীবন যাপন করতো। ইহুদী জাতির বছরের মাসগুলো ছিল চান্দ্রমাস। যাদের নাম ছিল যথাক্রমে ‘‘তিশরি, হেশবান, কিসলেব, তেবেত, শেবেত, আদার, নিসান, আইয়ার, সিবান, তামমুঝ, আব ও ইলুল’’। তাদের ধর্মী উৎসবের নাম ছিল ‘‘গোদালিয়াহুর রোজা, ইয়াম কিপুর, সোলেমান পরিষদের ৮ম দিন, তৌরাত উৎসব, হানকু ব্রতের শেষ, বৃক্ষাদির নববর্ষ, ইসতারের উৎসব, ভাগ্য বা লটারীর উৎসব, তামমুঝের উপবাস ও আব ৯-এর উৎসব’’। ইহুদী ধর্মীয় পন্ডিতদের বলা হতো ‘রাবিব’, যারা ধর্মীয় বিচার কাজও পরিচালনা করতো ঐ সময়। ২০১৩ সনের পৃথিবীতে ইহুদী বা Judaism ধর্ম অনুসারী মানুষ ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ, যার শুরু খ্রীস্টপূর্ব ১৩ শতকে। এ ধর্মের উপবিভাগ ও অনুসারী সংখ্যা ছিল যথাক্রমে Conservative 45 লাখ, Unaffiliated and Secular 45 লাখ, Reform 37 লাখ, Orthodox 20 লাখ, Reconstructionist ১ লাখ ৫০ হাজার। ইহুদীদের ধর্মীয় কিতাব তাওরাত মতে, পৃথিবীতে মানুষের আগমন হয়েছিল ২০১৩ সনের প্রায় ৫৮০০ বছর আগে। এই ধর্ম পুস্তকের হিসেবে আদমের ১৯৪৮ বছর পর আব্রামের জন্ম, নুহের জন্ম আদমের ১০৫৬ বছর পর। নবীগণের জীবনকাল ছিলো-আদমের ৯৩০ বছর, শীশ ৯১২ বছর, নুহ ১৪০০ বছর, হুদ ৪৬৪ বছর, আব্রাম ১৩৫ বছর, ইয়াকুব ১৪৭ বছর, ইউসুফ ১০০ বছর, আইয়ুব ১৪০ বছর, মোজেস ১২০ বছর, ইউশা ১১০ বছর, দাউদ ৭০ বছর, ঈসা ৩০ বছর পৃথিবীতে বেঁচেছিলেন। আর নবীরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন- আদম ১-হবুতী সনে, শীশ ১৩০-হবুতী সনে, নুহ ১০৫৬ সনে, সাম ১৫৫৬ সনে, আব্রাম ২০৮৭ সনে, ইয়াকুব ২১৪৭ সনে, মোজেস ২৪১২ সনে, দাউদ ৩১০৯ সনে, সোলাইমান ৩১৪৯ সনে, ঈসা ৪০০৪-হবুতী সনে।

২০১৫ সনেরও ২৫০০ বছর আগে প্রাচীন পৃথিবীর ইহুদীরা নিজেদের একেশ্বরবাদী ধর্মের ঐতিহ্যে লালিত ‘শ্রেষ্ঠ’ জাতি তথা ‘বনি ইসরাইল’ মনে করতো। তাদের ধর্মীয় প্রধান পুস্তক ‘তৌরাত’ অনেকগুলো অনুচ্ছেদে বিভক্ত ছিল যথাক্রমে পয়দায়েশ, হিজরত, লেবীয়, শুমারী ইত্যাদি। তৌরাতের নবীদের কাহিনীর অনুচ্ছেদগুলো ছিল যথাক্রমে ইউশা, কাজীগণ, রূত, শামুয়েল, বাদশানামা, খান্দাননামা, উযায়ের, নহিমিয়া, ইস্টের, আইয়ুব, জবুর শরীফ, মেসাল, হেদায়েতকারী, সোলায়মান, ইশাইয়া, ইয়ারমিয়া, মাতম, ইহিষ্কেল, দানিয়েল, হোসিয়া, যোয়েল, আমোস, ওবদিয়, ইউনুস, মিকাহ্, নাহুম, হাবাক্কুক, সফনিয়, হগয়, জাকারিয়া, মালাখি ইত্যাদি। এ ছাড়াও তৌরাতে দুনিয়ার ইতিহাস, সৃষ্টি, আদম ও হাওয়া, আদন বাগান, হাবিল কাবিল, শিস ও তার বংশধর, মহাপস্নাবন, নুহ, হাম-সাম, ভাষার জন্ম, ব্যাবিলন, ইসরাইল জাতির আদি পিতারা, ইব্রাহিম, লুত জাতি, হাজেরা ও সারা, আবিমালেক, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, ফেরাউন, এহুদা, বনি ইসরাইল, মুসা ও ইশাইয়া নবী, ইয়ারমিয়া, ইহিস্কেল, দানিয়েল, হোসিয়া, যোয়েল, মিকাহ, হাবাক্কুক, সফনিয়, জাকারিয়া, মালাখি, মিশরের ঘটনা, ইমাম, কোরবানী, ঈদ, বিশ্রাম, মানত, তুর পাহাড়, আদম শুমারী ইত্যাদি উপ-ভাগ ছিল।

‘তৌরাত’ ছাড়াও ইহুদীরা প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তক হিসেবে ‘জবুর’কেও পবিত্র আসমানী কিতাব মনে করতো। জবুরে ১৫০টি ধর্মীয় গান ছিল, যার রচনাকাল ছিল ১০০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে। তাদের মতে, এর ৭৩-টির রচয়িতা ছিল ‘দাউদ নবী’ নিজে। এ ছাড়া আসফ ১২টি, কারুণের ছেলে ১০টি, সোলায়মান নবী ২টি, মুসা ১টি, এথন ১টি ও উযায়ের নবী ১টি গান রচনা করেছিলেন। সোলায়মান, হিস্কিয়ের, আগুর ও বাদশাহ লমুয়েলের উপদেশ গ্রন্থ ‘মেসাল’ নামে বিখ্যাত ও পাঠ্য ছিল ইহুদী জাতির কাছে। যা পরবর্তীতে খ্রীস্টানরা ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ হিসেবে বাইবেলে লিপিবদ্ধ করে। আসলে বাইবেল ছিল নিউ ও ওল্ড টেস্টামেন্টের সমন্বয়, তথা ইহুদী ধর্ম ও যীশুর জীবন কাহিনীর ইতিহাস ছিল।

এরপর পর্ব – ৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন