রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার ইতিহাস পর্ব-৪ # ১০৬

ইহুদি (ইসরাইলি) জাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার ইতিহাস পর্ব-৪
ইহুদীদের স্বর্গদূত ছিল ৩-প্রকার যথা : সিরাফিম, চিরাবিম ও ওনাকিম। তালমুদে ফেরেস্তাদের কার্যবিভাজন ছিল নিম্নরূপ : মানুষের চিন্তা বহনকারী আফত্রিয়েল, যিহোভার বাণী বহনকারী গাললিজুর, ঝড়ঝঞ্চার নিয়ন্ত্রক বেননেজ, কারেন্ট নিয়ন্ত্রক বারাকিয়েল, রাত্রি নিয়ন্ত্রক লাইলাহেম, শিলাবৃষ্টি নিয়ন্ত্রক জোরকামি, ভূমিকম্প নিয়ন্ত্রক রাশিয়েল, তুষারপাত নিয়ন্ত্রক সালগিয়েল, সমুদ্র নিয়ন্ত্রক রাহাব, সানডেল ফিরিস্তা পৃথিবী থেকে স্বর্গ পর্যন্ত দন্ডায়মান। মেঘ ও বৃষ্টির নিয়ন্ত্রক রেডিয়াও এবং মেটাট্রোন ছিলো বনি ঈসরাইলীদের পথ প্রদর্শক ও পৃথিবীর সুপারভাইজার। অতিরিক্ত ক্ষমতাধর ফেরেস্তা হিসেবে ছিলো মাইকেল, র‌্যাফেল, গ্যাব্রিয়েল, উরিয়েল। শয়তান ছিল সিরাফিম গোত্রের ‘সামমায়েল’ নামধারী ফেরেস্তা।

ওল্ড টেস্টামেন্ট মূলত হিব্রু ও এরামাইক ভাষায় রচিত ছিল। তৌরাতের ব্যাখ্যা, টিকা, টিপ্পনীর কিতাব ছিল ‘মিশনা’। মিশনার অপর অংশের নাম ছিল ‘গেমারা’। ১২০-২২০ সনের মধ্যে ইহুদী ‘এমোরাইম’ পন্ডিতগণ হিব্রু ভাষায় ‘মিশনা’ ও ‘এরোমাইক’ ভাষায় ‘গেমারা’ রচনা করেছিল। মানব জীবনের সকল দিক এইসব ধর্মীয় কিতাবে বর্ণিত হয়েছিল। ইহুদী রাববীদের মতে সকালে, বের হওয়ার আগে ও আহারের পূর্বে ও দৈনন্দিন সকল কাজে যিহোবার উপাসনা করার রীতি চালু ছিল। ইহুদীদের মধ্যে বর্ণভেদ ছিলনা বরং তাদের সৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান ছিল। ইহুদীদের ধর্মীয় ইতিহাসে আব্রাম, ইসহাক ও ইয়াকুব নবী মেসোপটেমিয়ার ‘হারান’ শহরে বসবাস করতো পরিবারসহ। খ্রীস্ট পূর্ব ১৯০০ অব্দে ‘আব্রাম’ যিহোবার নির্দেশমত ইহুদীদের কেনান নিয়ে যায়। ইয়াকুব নবীর অপর নাম ইসরাইল ছিল বলে, ইহুদীরা ইসরাইলী নামেও পরিচিতি লাভ করে। ইহুদীদের মতে আদম থেকে মুসা পর্যন্ত সকল মানুষ যিহোবার উপাসনা করতো, তবে তাকে অন্য নামে ডাকতো। রোমানরা ইহুদী নবীদের ‘প্যাট্রিয়ার্ক’ বলতো। 
 
‘প্যাট্রিয়ার্ক’ অনুসারীদের চেনার জন্যে তাদের খাতনা বা লিঙ্গচ্ছেদের বিধান করা হয়েছিল। আব্রাহামিক ইহুদীরা স্বর্গের জন্যে নয়, কিনান দেশ পাওয়ার লোভে যিহোবার উপাসনা শুরু করেছিল। মিশর থেকে সিনাই হয়ে কিনান ফেরার পথে ইহুদীরা নিরাকার যিহোবার উপাসনা শেখে। আব্রামের পর সাউল, দাউদ ও সোলেমান ইহুদীদের রাজা হয়েছিলো। সুলেমানের মৃত্যুর পর কিনান ভাগ হয়ে ১টি ইসরাইল, অন্যটি জুদিয়া নামে বিভক্ত হয়। নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসরাইলের মন্দিরে ইহুদীদের আকৃষ্ট করার জন্যে ‘সোনার বাছুর’ স্থাপন করা হয়েছিল। ৭২১ খ্রী. পূর্বাব্দে ইসরাইল রাষ্ট্রের পতন ঘটলে, ইহুদী নবী হোসিয়া এই পতনকে ‘যিহোবা’র উপাসনা ভুলে থাকার পাপ বলে ব্যাখ্যা করেন। ৪৪৪ খ্রী. পূর্বাব্দে পারস্যরাজ ইহুদীদের তৌরাত পাঠের অনুমতি ও সামারিতানদের ইহুদী ধর্মে অন্তর্ভুক্তির অনুমতি প্রদান করলে, তৌরাত আধুনিকায়নে ‘মিদরাশ’ প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮ খ্রী. পূর্বাব্দে গ্রীকরা ইহুদী রাজ্য দখলে নিলে ‘সোফেরিম’, ‘হাসডিম’, ‘সাদদুচি’ নামে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যাকারী ইহুদী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এ সময় উদার ‘ফরিসী’দের উদ্যোগে ৭১-সদস্যের বৃহত্তম ‘সামহেড্রিম’ কাউন্সিল গঠিত হয়। ৭০ সালে রোমানরা জেরুজালেম মন্দির ধ্বংস করে এবং ১৩৫ সালে ইহুদীদের তৌরাত পাঠ ও লিঙ্গচ্ছেদ ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করে। নানা ঘাত প্রতিঘাতের পর ২২০ সালে ইহুদীরা তাদের হাদিসগ্রন্থ বা ‘তালমন্দ’ প্রস্তুত করতে সমর্থ হয়। এমোরাইম নামক ইহুদী পন্ডিতরা এ সময় তালমন্দের জন্যে নানাবিধ ধর্মীয় নিয়মকানুন প্রণয়ন করে। ষষ্ঠ শতকে ইসলাম ধর্মের আগমনে ভীত রাববীরা ‘কাবাইত’ আন্দোলন শুরু করে। এ সময় তৌরাত থেকে মানব রচিত অংশ বাদ দেয়ার প্রশ্ন উঠে। এ সময় স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানী থেকে ইহুদী ধর্ম প্রচার ব্যাপক আকার লাভ করে। ১৪৯২ ও ১৫০৬ সনে স্পেন ও পর্তুগাল থেকে ইহুদীদের বহিষ্কার করা হলে, তারা ইতালীতে আশ্রয় নেয়। ক্রমান্বয়ে ঘা খাওয়া ইহুদীরা দার্শনিক মোসেস মেন্ডেলসান ও ইহুদী কবি নাফতালিজ এর নেতৃত্বে সংস্কারমূলক ‘হাসকালা’ আন্দোলনে নামে। এর ফলশ্রতিতে ইহুদীরা তৌরাত, তালমন্দ, মিশনা, মিদরাশ এর ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বেড়িয়ে আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষায় নিজেদের স্নাত করে। ১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০ সিনাগগ প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদীদের দ্বারা। 
 
১৯৪৮ সনে তৌরাত বর্ণিত ‘যিহোবা’ প্রতিশ্রুত ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র প্যালেস্টাইনে পুন. প্রতিষ্ঠিত হলে, আরবদের সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে ইহুদীদের যথাক্রমে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সনে যুদ্ধ বাধে। যা এই ২০১৩ সনেও নানা প্রপঞ্চে চলমান ছিল। ২০১৩ সনে ইহুদীরা ‘ইসরাইল’ নামে একটি ক্ষুদ্র ইহুদী রাষ্ট্র বসবাস করতো, যাতে সাকুল্যে ৭.৪ মিলিয়ন ইহুদী বসবাস করলেও, ঐ সময়ের বিশ্বকে তারা নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো বুদ্ধি আর কূট-কৌশল প্রয়োগে। পৃথিবীর প্রাচীন ৪০০০ বছরের ব্যবিলন থেকে ২০১৩ সনের যুক্তরাষ্ট্রীয় সভ্যতার সর্বত্রই ইহুদী জাতির জয়জয়কার ছিল। তারা সম্ভবত ধার নিয়েছিল পৃথিবীর নানা জাতি থেকে মাটি কামড়ে বেঁচে থাকার নানাবিধ উপাদান। ইহুদীদের মতে তারা ছাড়া ২০১৩ সনের খ্রীস্টান, মুসলমান ও অন্য সকল প্রচলিত ধর্মামলম্বীরা ভণ্ড তথা মিথ্যবাদী ছিল।

অন্যান্য অনেক ধর্মের মত ইহুদীদের ধর্মেও যুদ্ধজয়ের পর অগণিত যুদ্ধবন্ধীকে কব্জা করার পর নবী মোজেস ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা ছিল, ‘‘এখন তোমরা এইসব পুরুষদের এবং কুমারী নয় এমন মহিলাদের হত্যা কর কিন্তু কুমারীদের বাঁচিয়ে রাখ নিজেদের জন্যে’’ (তাওরাত গণনা পুস্তক, ৩১:১৭-১৮)। ঐ সময়ের মোজেস এর নির্দেশে যুদ্ধবন্ধী ১ লাখ পুরুষ ও ৬৮,০০০ নারীকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও তাওরাতে বিভিন্ন নিষ্ঠুর, আক্রমনাত্মক ও অরাজক কথাবার্তার প্রমাণ পাওয়া যায় যিশাইয় (২১:৯), বংশাবলী (২০:৩), গণনা পুস্তক (২৫:৩-৪), বিচারকগণ (৮:৭), ২য় বিবরণ (১২:২৯-৩০), শমুয়েল (৬:১৯), ডয়টারনোমি (১৩:৪,৫,৮,৯,), আদিপুস্তক (৯:৫-৬) প্রভৃতি অধ্যায়ে। আদিপুস্তক মতে, আদমের ৪০,০০০ সন্তান, দাউদের ৯-স্ত্রী, সোলায়মানের ৩০০-স্ত্রী ও এক-হাজার দাসী/বাঁদী ছিল। তৌরাত মতে জগতের সৃষ্টি খূ.পূ ৪০০৪ অব্দে, সে হিসেবে পৃথিবীর বর্তমান বয়স ৬০১৬ বছর, অথচ জ্যোর্বিজ্ঞানের মতে ৪০০-৫০০ কোটি বছর।
 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন