মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে যেভাবে বিতাড়িত করে : ইয়াজিদি ধর্ম সম্প্রদায় # ২ [১৪৬]



ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে যেভাবে বিতাড়িত করে : ইয়াজিদি ধর্ম সম্প্রদায়
[ ৩-পর্বের ইয়াজিদি মানুষের গল্পের পর্ব নং ২ ]
:
বলা হয়, প্রায় ছয় হাজার বছর পুরনো এই সম্প্রদায়ের ওপর মোট ৭২ বার গণহত্যা চালানো হয়েছিল বলে এক ইয়াজিদি বিশ্লেষকের অভিমত। ধর্মীয় কারণে জীবন দহনে নিষ্পেষিত ইয়াজিদি নাম শুনে অনেকেই মনে করেন ইসলামের পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদের বংশধর কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদিদের সঙ্গে ইয়াজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইয়াজিদি শব্দটি এসেছে ফার্সি 'ইজদ' থেকে, যার অর্থ দেবদূত। তবে এই সম্প্রদায়টি নিজেদের পরিচয় দেয় দাসিনহিসেবে। আইএসসহ (আইএসআইএল বা ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট) সুন্নি চরমপন্থি গোষ্ঠিগুলোর বিশ্বাস, ইয়াজিদি নামটি এসেছে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নাম থেকে। উমাইয়া বংশের দ্বিতীয় খলিফা (৬৪৭-৬৮৩) ইয়াজিদ অত্যন্ত "অজনপ্রিয়" শাসক ছিলেন, কারবালার ঘটনার সাথে এ নামটি বেশ জড়িত। তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, এ গোষ্ঠীর নামটির সঙ্গে খলিফা ইয়াজিদ বা পারস্যের (প্রাচীন ইরান) শহর ইয়জদ নগরের (যেটি মুলত এখনো জরথ্রুস্টবাদি হিসেবে পরিচিত) কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নামটি নেওয়া হয়েছে আধুনিক ফার্সি ইজদথেকে, যার অর্থ হচ্ছে দেবদূত বা দেবতা। তা থেকে ইয়াজিদি শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে, ‘ঈশ্বরের উপাসক। ইয়াজিদিরা ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন এবং খ্রিষ্টধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল উভয়কেই শ্রদ্ধা করে থাকে। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় প্রথাগুলোর বেশির ভাগই মৌখিক। এমন ভুল ধারণাও রয়েছে যে, ইয়াজিদি মতবিশ্বাস জরথুস্ত্রবাদ (প্রাচীন পারস্য ধর্মীয় বিশ্বাস ও দর্শন, যার অনুসারীরা অগ্নি উপাসক বা পার্সি বা "মাজুসি" নামে পরিচিত) মতবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
:
ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কাছে মালিক তাউস এবং শেখ আদি দুজনকেই সমভাবে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করা হয়। শেখ আদি দাবি করেন, তার জন্ম সৃষ্টির শুরুর দিকে এবং আদম (প্রথম মানব) যখন স্বর্গে বাস করতেন, তখন শেখ আদি উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া নমরুদকে যখন নীল নদে ফেলা হয় তখন শেখ আদি সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। এ ছাড়া ইয়াজিদিরা ইসলাম এবং খ্রীস্টান ধর্মমতবাদের অনেক বৈপরীত্য বিষয় বিশ্বাস করে। এই কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তারা শয়তানের পূজারী হিসেবেই চিহ্নিত। প্রাক ইসলামিক যুগ হতে শয়তানের পূজারী হওয়ার কারণে তাদের প্রতি নানা অত্যাচার এবং হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
:
শেখ আদি ইবনে মুসাফির একজন সুফি সাধক। মসুলের উত্তর-পূর্ব শহর লালিস উপত্যকায় দ্বাদশ শতাব্দীতে তিনি বসবাস শুরু করেন। ১১৬২ খ্রিস্টাব্দে শেখ আদির মৃত্যুর পর তার কবরকে কেন্দ্র করেই ইয়াজিদি বংশের লোকজন তীর্থ যাত্রার প্রচলন শুরু করে। এছাড়া ইয়াজিদিরা খলিফা ইয়াজিদকে একজন মহান আত্মার পুনর্জাগরণ বলে মনে করে। শুধু তাই নয়, ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মালিক তাউস হলো বিশ্বের দায়িত্বরত একজন দূত। এবং ঈশ্বরের দ্যুতি হতে মালিক টাউসের সৃষ্টি। সৃষ্টির পর ঈশ্বর মালিক তাউসকে নির্দেশ করেন ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোন বস্তুকে সিজদা না করার। এই কারণে পৃথিবীর ধুলা হতে সৃষ্ট আদমকে (প্রথম মানব) মালিক তাউস সেজদা করেনি। আদমকে সেজদা করা ঈশ্বরের নির্দেশ হলেও তা ছিল মালিক টাউসের প্রতি একটি পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষায় মালিক তাউস উত্তীর্ণ করে এবং ঈশ্বরের প্রশংসা লাভ করে। প্রচলিত ধর্ম মতবাদরে এমন বৈপরীত্য বিশ্বাসের কারণে ইয়াজিদি সম্প্রদায় মধ্যপ্রাচ্যে নানা অত্যাচার এবং নির্যাতনের শিকার হয়।
:
ব্যাপ্টিস্ট খ্রিষ্টানদের মতো ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের শিশুদের সর্বাঙ্গ পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে দীক্ষা দেন একজন পীর। ডিসেম্বর মাসে ইয়াজিদিরা তিন দিন রোজা রাখে। পরে পীরের সঙ্গে সুরা পান করে। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখ ইয়াজিদিদের বার্ষিক তীর্থযাত্রার সময়। এ সময় তারা মসুল শহরের উত্তরে অবস্থিত লালেশ এলাকার শেখ আদির মাজারে গিয়ে নদীতে ওজুর মতো করে পবিত্র হয়। এ ছাড়া ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মধ্যে পশু উৎসর্গ করা (কুরবানী) এবং খতনা দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। ইয়াজিদিদের সর্বোচ্চ দেবতার নাম ইয়াজদান।
:
[এর পর শেষ পর্ব। যাতে পাবেন আইএস কর্তৃক ইয়াজিদি পুরুষ হত্যা, নারীদের ধর্ষণ আর সেক্স হাটে বিক্রির গল্প)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন