শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কবে আ্মরা প্রকৃত মানুষ হওয়ার বয়ান শুনতে পাবো? [ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ # ২৬ ]

কবে আ্মরা প্রকৃত মানুষ হওয়ার বয়ান শুনতে পাবো?

প্রতি বছর অনেক প্রচার প্রচারণা, মাস ব্যাপী নানাবিধ আয়োজনের মাধ্যমে ঢাকার টঙ্গী তথা তুরাগ নদীর তীরে বা ‘কহর দরিয়া’র পাড়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বইজতিমা’, এ দেশের শহর গ্রাম তথা চারদিকে থেকে পিপঁড়ার মত লাখ লাখ মানুষ ছাড়াও, বিদেশ থেকেও অনেক মুসলমান এখানে উপস্থিত হয় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায়। সাধারণ মানুষ ছাড়াও আমাদের দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক ‘ভিআইপি’ ও ‘ভিভিআইপি’ (প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলীয় প্রধানসহ অনেকেই) -গণও এই জমায়াতে যোগদান করেন তাদের মনোবাঞ্ছা পুরণার্থে। ‘তাবলীগ জামায়াত’ ছাড়াও সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও তহবিল থেকেও এ ইজতিমার জন্যে ব্যাপক আঞ্জাম আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হয় প্রতি বছর, পিছিয়ে থাকে না টঙ্গী পৌরসভাও। পত্রিকা মারফত জানা তথ্য মতে, ২০০৭ সনে সু্ষ্ঠুভাবে ইজতিমা সম্পন্ন করার জন্যে প্যান্ডেল তৈরী হয়েছিল ১৬০-একর জমিতে এবং প্রতি বছরইএই আয়োজন ও স্থান বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। সারা দেশ থেকে লঞ্চ, নৌকা, ট্রলার, স্টিমার, বাস,ট্রেন, ট্রাক ইত্যাদি প্রায় সকল যানবাহন যোগে স্রোতের মত মানুষ এই বিশ্ব ইজতিমায় যোগ দিয়েছে এবং অনুরূপ পদ্ধতিতে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরছেও। ইজতিমা শেষে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের কামড়া,ছাদ, ইঞ্জিনসহ সর্বত্র শুধু শুধু মানুষ আর মানুষ, যেন এক ‘এলাহী কান্ড’। এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে সার্বিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা, এ্যাম্বুলেন্স, পানি, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ইত্যাদির জন্যে নানাবিধ আয়োজন করতে হয়েছে সরকার, র্যা ব, সেনাবাহিনি ও বিভিন্ন সংস্থাকে। বিগত ইছতেমায় কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ২২,০০০ সদস্য নিয়োজিত ছিল শান্তি শৃঙখলা রক্ষার দায়িত্বে। অনেক অফিসেও শেষদিন আখেরী মুনাজাতের কারণে ঠিকমত অফিস হয়নি কিংবা আংশিক হয়েছিল। প্রায় অধিকাংশ যানবাহন, এমনকি বিআরটিসির বাসও এ উপলক্ষে ইজতিমামুখী হওয়াতে ঢাকা শহরসহ দেশের সর্বত্র এর প্রভাব পড়েও যাত্রীদের গাড়ির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুঃখ পোহাতে হয়। বিশাল এ জামায়াত উপলক্ষে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের ঢাকা আগমনে বলতে গেলে ঢাকা শহর ২/১ দিনের জন্যে ‘কলাপ্স’ হয়ে যায়। টঙ্গী ও উত্তরাবাসীর ব্যবসা-বাণিজ্য ও সুবিধা অসুবিধার কথা না হয় বাদই দিলাম এ প্রসঙ্গে। যদিও নবী (স) বলেছেন, ‘‘কেবল ৩টি মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে ১) নবীর মসজিদ (মানে মদিনার মসজিদে নববী) (২) মসজিদুল হারাম (মক্কার কাবার চারদিকের মসজিদ) ও (৩) বায়তুল মুকাদ্দাস’’ (সূত্র : মুসলিম শরীফ-৩১২৯, ৩২৫৪)।

কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন এ বিশাল আয়োজন? এর সঙ্গে পবিত্র ধর্ম ইসলামের সম্পর্ক কি?। আমাদের মত জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত গরিব দেশের জন্যে এ আয়োজন ইসলাম সম্মত কিনা কিংবা আমাদের মত গরিব দেশের আদৌ এরূপ বৃহৎ অনুষ্ঠান করার সামর্থ, যোগ্যতা ও প্রয়োজনিয়তা আছে কিনা। বর্তমানে ইসলামের নামে আমরা অনেক কার্যক্রম চালু করেছি, যা নবী (সঃ) এর সময় ছিলনা। ধর্মীয় ব্যাপারে আমরা যেহেতু খুবই আবেগ প্রবণ, তাই এই ব্যাপারে খুব একটা যুক্তির ধার ধারিনা বা যুক্তি দিয়ে বা বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারের চেষ্টা করিনা শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রায় সবাই। আমরা প্রতি বছর ইজমিতায় অন্য দেশে না গিয়েও দেশে বসে (এ ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের বাসিন্দারা অধিক সৌভাগ্যবান) নানা‘হেদায়াতী বয়ান’ শোনার সৌভাগ্য অর্জন করছি, ভাল মানুষ, খোদা ভীরুতা, পাপের পথ থেকে ফিরে আসার নসিহত, সৎ তথা ভাল মানুষ হওয়ার কথা শুনছি কিন্তু তা কি হয়েছি বা হচ্ছি আমরা? দীর্ঘদিন এই ইজতিমা আয়োজন ও এর মাধ্যমে ধর্মীয় চমৎকার সব কথাবার্তা শোনার কারণে আমাদেরই উচিত ছিল ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষ হওয়ার’, আর যারা শুনছেনা, তাদের হওয়ার কথা ছিল তুলনামূলকভাবে ‘খারাপ মানুষ’, পোকায় খাওয়া, পচা, মানুষের খাওয়ার অনুপোযোগী গম আমদানি ও আটা হিসেবে প্যাকেটজাত করে বিক্রি, ভেজাল জীবন রক্ষাকারী ঔষধ ও খাবার মজুদ থাকার কথা ছিল ডেনমার্ক, হল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের গুদামে, কারণ তারা এরূপ ইজমিতার মাধ্যমে কখনো ‘ভাল মানুষ হওয়ার বয়ান শোনেনি’ কিন্তু আমরা যারা শুনছি তারাই ঐ কাজটি করছি অব্যাহতভাবে। যারা শোনেনি, তারা করছে না বা করলেও খুব কম করছে। তাহলে এই ইজতিমার ‘আউটপুট’ কি? আর কোন আয়োজনের যদি কোন ‘আউটপুট’ নাই থাকে, তবে এতো কষ্ট, এতো খরচ, এতো বিরাট আয়োজন করে আমাদের লাভটা কি তাহলে?

পবিত্র ধর্ম ইসলামে ‘হজ্ব’ নামক বৃহৎ মুসলিম সমাবেশের কথা বলা হয়েছে, যা ‘সম্পদশালী মুসলমানের জন্যে ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয়, যেখানে একত্রিত হওয়াও বিশ্বের ধনবান মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। অন্য কোন মহাসমাবেশের কথা হাদিস কোরানের কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম এ জন্যে পৃথক ও আধুনিক যে, অন্য ধর্মের প্রার্থনা সম্পাদনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় গুরু (যেমন পুরোহীত, পাদ্রী, পন্ডিত, ভিক্ষু) দরকার কিন্তু ইসলামে তা না হলেও কোন সমস্যা নেই। হিন্দুরা ব্রাহ্মণ ছাড়া পূজা. খৃষ্টানগণ পাদ্রী ছাড়া প্রার্থনা না করতে পারলেও, মসজিদ এবং ইমাম ছাড়াও মুসলমানগণ তাদের নামাজ তথা ধর্মীয় প্রার্থনা আদায় করতে পারে, এমনকি মসজিদ ছাড়া হাটে,মাঠে, বাজারে এমনকি যে কোন স্থানেও। অন্যদের প্রার্থনা ভায়া মাধ্যমে গেলেও, মুসলমানগণ কারো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর কাছেসব কিছু চাইতে পারে এবং এভাবেই আল্লাহ এবং তাঁর প্রেরিত নবী (স.) আমাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং ইসলামের আধুনিকতা ও অনন্যতাও এখানেই। তা ছাড়া আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, তিনি পবিত্র ‘মক্কা’ ও ‘মদিনা’ ছাড়া বিশেষ কোন স্থানে ‘জিকির-মাহফিলে’ বিশেষ কোন ফায়দা বা সওয়াবের কথা কোথাও বলেননি। মসজিদুল হারামে (কা’বা ঘরের চারদিকের মসজিদ) নামাযে এক রাকাতে এক লাখ গুণ ও মসজিদে নববীতে (মদীনার নবীর বাসস্থান সংলগ্ন মসজিদ) এক রাকায়াত নামাজে পঞ্চাশ হাজার গুণ সওয়াবের কথা বলা হয়েছে। আর মহাসমাবেশ বলতে কেবল ‘পবিত্র হজ্ব’কে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহকে টঙ্গীর তুরাগের পাড়ে ডাকলে তার বিশেষ কোন মরতবা হবে, ঢাকা, মনপুরা বা বরিশালের নিজস্ব বাড়িতে ডাকলে তিনি সারা দেবেন না, এমন কথা ইসলামে কোথাও বলা হয়নি বা নেই।

এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যেখানে সম্পদশালী কোন মুসলিম দেশে এ জাতীয় কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে না, সেখানে আমাদের মত গরিব, জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত, আর্থিক দৈন্যতার দেশে এ জাতীয় ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান করার যুক্তি কি? বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির যুগে কোন ধর্মীয় বিষয় জানার জন্যে বিশেষ কোন স্থানে ব্যক্তিগত হাজির হয়ে কিংবা সারারাত জেগে কারো ওয়াজ নসিহত শোনার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। বর্তমানে মৌলিক ও অনুদিত বিবিধ ধর্মীয় বই-পুস্তক,পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, সিডি, ভিসিডির যুগে সব কিছু এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। সিডিতে এখন চমৎকার বাংলা ইংরেজি তরজমাসহ পুরো কোরআন শরীফ পাওয়া যাচ্ছে। এদেশে এখন প্রতিদিন বিভি্ন্ন মানুষ স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে নানা অনুষ্ঠানে নানাভাবে সরাসরি প্রশ্ন করে অনেক ধর্মীয় বিষয়, মাসলা ইত্যাদি জানতে ও নানা ব্যাপার শিখছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশের প্রায় সব টিভি চ্যানেলে বিকেলে ও সন্ধ্যায় এই জাতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে নিয়মিত।বিশ্বখ্যাত ভারতীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ড. জাকের নায়েকের ইসলামী তাফসির ও প্রশ্নোত্তর এখন বাংলা-ইংরেজিতে ডাবিং করা অবস্থায় সিডিতে পাওয়া যাচ্ছে, কোন কোন টিভি চ্যানেলে তা নিয়মিত প্রচারিতহচ্ছে।

কয়েক বছর আগে পবিত্র কা’বা ঘরে হজ্বের সময় ‘হাজরে আসওয়াত’ (কাল পাথর) ‘চুমু’ দিতে গিয়ে অন্যান্য হাজিদের ধাক্কায় হজ্ব পালনরত আমার জনৈক মহিলা আত্মীয়ের পরণের কাপড় ছিড়ে গিয়েছিল এবং তিনি অন্য হাজীদের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলেন এবং সঙ্গে থাকা অন্য সঙ্গী মহিলাদের বোরকাসহ মাথার চাদর ইত্যাদি কোথায় চলে গিয়েছিল তার আর খোঁজ আর পাওনা যায়নি। এ ব্যাপারে জনৈক সৌদি দীনি আলেমকে (যিনি সৌদি হজ্ব, দাওয়া বিভাগের উচ্চতর পদে কর্মরত) জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘হাজরে আসওয়াত’ চুমু দেয়া কোন অত্যাবশ্যক কাজ নয় বা চুমু না দিলে গুনাহ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বা এটি হজ্বের কোন অনুসঙ্গও নয় কিন্তু চুমু দিতে গিয়ে কোন মুসলমানকে ‘আঘাত’ করলে বা ‘কষ্ট দিলে’ কবিরা বা বড় মাপের গুণাহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ১০০%। সেই দৃষ্টিতে‘হাজরে আসওয়াত’ চুমু দিতে গিয়ে অনেকেই ‘কবিরা গুণাহ’ সঙ্গে করে ফিরে আসেন। কথাটি আমার খুবই যৌক্তিক ভাবে মনে ধরেছিল এবং সেই থেকে হিসাব করছি কোন ‘পুণ্যে’র কাজটি করতে গিয়ে আসলে ‘পাপ’ করে ফেলছি কিনা।

ইসলামে অপচয়কারিকে শয়তানের ভাই বা বন্ধু বলা হয়েছে। সৌদি আরবসহ অনেক মুসলিম দেশে ঈদের নামায পড়া হয় মসজিদে। রাসুল্লালাহ (সঃ) এর আমলেও ঈদের নামাজ মসজিদেই পড়েছেন। আমরা এই স্বল্প জমির অধিক মানুষের গরিব মুসলমানের দেশে হাজার হাজার ঈদের মাঠ বানিয়ে রেখেছি, যাতে বছরে মাত্র ২-দিন (তাও মাত্র ঘন্টা দুয়েকের) ঈদের জামাত হয়, বাকি ৩৬৩ দিন খালি পড়ে থাকে এমনকি তাতে কোন ফসলও চাষ করিনা বা করতে দেইনা। আমরা কি ঈদের ২ দিনের নামাজ মসজিদে বা স্টেডিয়ামে, স্কুলের বা খেলার মাঠে পড়তে পারিনা? তাতে কি ইসলাম চলে যাবে বাংলাদেশ থেকে? জমির অপচয় রোধ হলে হয়তো আমাদের গরিব মানুষের আরো কিছু অংশ মাথা গোজার ঠাঁই পাবে, নয় কি? তাতে মনে হয় মহান আল্লাহ তাঁর ‘বাস্ত্তহারা’ বান্দাদের নিজস্ব ‘বাস্ত্ত’ বা ঘর হওয়াতে বেশী খুশী হবেন, হাজার হাজার ঈদের মাঠ বানিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মাথা গোজার ঠাঁই থেকে বঞ্চিত করার পরিবর্তে। আমাদের কি এতো জমি আছে অপচয় করার মত? বাংলাদেশের মুসলমানদের উচিত এইসব বিষয় ইজমা-কিয়াস তথা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা, আবেগের বসবর্তী হয়ে যে কোন কাজ করা নয়। আসুন আমরা সবাই দেশপ্রেমিক, অপচয় বিরোধি, প্রকৃত মুসলমান তথা ভাল মানুষ হই; গড্ডলিকা প্রবাহে প্রবাহিত হুজুগে বাঙালি ও ‘বাণিজ্যিক মুসলমান’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় আমরা আর কতকাল দেব? প্রকৃত মানুষ হওয়ার বয়ান আমাদের কে শোনাবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন