শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

জরথ্রুস্ট ধর্ম : মৃত্যুর পর দেহকে শকুন দিয়ে খাওয়ায় যারা ধর্মীয় বিশ্বাসে [ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ # ২৭ ]



জরথ্রুস্ট ধর্ম : মৃত্যুর পর দেহকে শকুন দিয়ে খাওয়ায় যারা ধর্মীয় বিশ্বাসে

জরথ্রুস্ট (زرتشت ) ছিলেন একজন প্রাচীন পারসিয় ধর্ম প্রবর্তক, যিনি যিশুর জন্মের অন্তত ৬৫০ বছর আগে (কারো মতে ১২০০ বিসি) তার ধর্মমত প্রচার করেন ইরানে। জরথ্রুস্টবাদ পারস্যের রাজ ধর্ম ছিল ঐ সময়, তথা মূলত সবাই এ ধর্ম পালন করতো তখন। ঐ সময়ের ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবে আরবরা এদেরকে ‘অগ্নি উপাসক’ হিসেবে ঘৃণা করতো। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা পারস্য দখল করলে, পার্সি ধর্ম বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়, ফলে অনেক পার্সি ঐ সময়ে ভারতে পালিয়ে যায় পৈত্রিক জীবন ও নিজ ধর্ম রক্ষার্থে। কিছু পার্সি জিজিয়া কর দিয়ে ইরানের ইয়াজদ ও কেরমান শহরে থেকে যায়, যাদের সংখ্যা বর্তমানে ইরানে প্রায় ২৫,০০০। ২০১৪ সনে ভারতের মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে প্রায় ৬৯,০০০ পার্সি তাদের ধর্ম পালন করে। ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান, আজারবাইজান ও যুক্তরাষ্ট্রে সর্বমোট ১,৩৭,০০০ জরথ্রুস্ট ধর্ম অনুসারি বিদ্যমান। ভারতের জাদরেল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীও পার্সি ধর্ম অনুসরণ করতেন বলে জানা যায়। পার্সিরা সূর্য তথা আগুনকে সব কিছুর স্রষ্টা মনে করে। তাই ২৪-ঘন্টা তাদের উপাসনালয়ে আগুন জ্বলতেই থাকে। 

শকুন দিয়ে মৃতদেহ খাওয়ানো !

জরথ্রুস্টবাদিদের বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুর পর মৃতদেহ সৎকার। শকুনেরা যেহেতু সবচেয়ে বেশী উচুঁতে উঠে সূর্যের কাছে যেতে পারে, তাই তারা নিজেদের মৃতদেহকে শকুন দিয়ে খাওয়ানো পবিত্র কর্ম মনে করে। মৃতদেহকে যাতে সহজে শকুনে খেতে পারে তার ব্যবস্থা করে তারা এবং মাংস শকুনে খাওয়ার পর মৃতের হাড়-মজ্জা ‘পবিত্র কুয়ায়’ ফেলে দেয়া হয়। তাদের বিশ্বাস, মরণের ৪র্থ দিনে ‘রুহ’ অহুর মাজদার কাছে বিচারের জন্যে পৌঁছে, এই ৪-দিন মৃতকে শকুন দিয়ে খাওয়ানো অত্যন্ত পূর্ণ কর্ম। কারো দেহ শকুনে না খেলে সেটা অবশ্যই অশুভ (হায়! ঐ সময় যদি শকুনের পেট ভরা থাকে বা মৃতের আধিক্য থাকে? তবে মৃতের কি হবে তখন?) 

জরথ্রুস্টবাদিরা যেখানে বাস করে সেখানে থাকার কথা মৃতকে শকুন দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। তবে ভারতে যেহেতু বর্তমানে সবচেয়ে বেশি এ ধর্মের লোক তাই, দক্ষিণ মুম্বাইর মালাবার হিলে ৫৭ একর অরণ্য-উদ্যানের মাঝে বিরাটাকার 'ডখমা' বা ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’ (নির্জনতার স্তম্ভ) নির্মাণ করা হয়েছে। ঐ পাহাড় চূড়ায় বিশাল আধার নির্মাণ করে সেই আধারের মাঝে পাথর বসিয়ে তার উপর মৃতদেহ রেখে আসে তারা। এ টাওয়ারে বা কাছাকাছি শকুনেরা বসে থাকে মৃতদেহটি খাবারের জন্যে। ৩-দিন খাওয়ার পর হাড়গোড়গুলো সংগ্রহ করে অন্যত্র কয়লা ও বালির মিশ্রণের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। এর নাম হাড়দানি (Ossuary ), এরপর যায় পবিত্র কুয়ায় (কবর?)।

বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, উপসাগরিয় দেশ ও নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী জরথ্রুস্টবাদি-দেরকে এমন “শকুনের টাওয়ার” নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়না বিধায়, তারা মৃতদের ইচ্ছানুসারে মৃত্যুর পর দেহ শকুন দ্বারা পবিত্র করণের জন্যে ভারতের মুম্বাই নিয়ে আসেন বিমানে!

বিস্ময়কর পৃথিবীর সব ধর্মীয় আচার ও ধর্মানুষ্ঠান। যার মান রক্ষার্থে মানুষ তার নিজ জীবন দিতে এবং অন্য বিশ্বাসীর জীবন নিতে এখনো কুষ্ঠিত হয়না এই ২০১৪-সনেও। মানুষের বিবেককে কি এ বিষয়গুলো একটুও নাড়া দেয়না? মানুষ কি পৃথিবীর প্রায় ৫,০০০ বছরের ধর্মের ইতিহাস পাঠ করে কিছুই শিখবে না? সে কি নিজ ধর্ম ছাড়া অন্যের ধর্ম আর ধর্মহীন মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখতেই থাকবে আমৃত্যু? হায় মানুষ, কখন ঘটবে তার বোধোদয়! 

চিত্র পরিচিতি :
মুম্বাইর টাওয়ার অব সাইলেন্সের উপরের দৃশ্য, সাজানো মৃতদেহ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন