হিন্দু বা বৈদিক ধর্ম : পর্ব # ৩
[১ম ও ২য় পর্বের পর]
[১ম ও ২য় পর্বের পর]
হিন্দু ধর্মে জীবনের ৪-টি অধ্যায় হচ্ছে যথাক্রমে ব্রহ্মাচার্য (ছাত্রজীবন), গার্হস্থ্য (সংসার জীবন), বাণগ্রস্থ ও সন্ন্যাস জীবন। হিন্দু গ্রন্থে মনু বলেছেন, ‘‘দাসত্বের কাজ নির্বাহ করার জন্যেই বিধাতা শূদ্রদের সৃষ্টি করেছিলেন’’ (৮:৪১৩)। ২০১৪ সনের ধর্ম বিশ্লেষক শ্রী এমসি রাজার ভাষ্য ছিল, ‘‘আপনি বাড়িতে কুকুর বেড়ালের চাষ করতে পারেন, গো-মূত্র পান করতে পারেন, পাপ বিনাশের জন্যে সারা গায়ে গোবর লেপতে পারেন কিন্তু নিম্নবর্ণের ছায়াটি পর্যন্ত আপনি মারাতে পারবেন না’’। শূদ্রদের যাতে অন্য ৩-বর্ণ থেকে আলাদা করে চেনা যায়, এ জন্যে প্রতি মাসে তাদের সব চুল কামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন মনু (৫:১৪০)। একজন শূদ্র ব্রাহ্মণের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে পড়লে তার বুকে গরম লোহার রডের ছ্যাকা অথবা পশ্চাৎদেশ কর্তনের বিধান ছিল (৮:২৮১)। তপস্যা করার অপরাধে রামচন্দ্র খড়গ দিয়ে শম্বুক নামক এক শূদ্রকে শিরোচ্ছেদ করেন নিজরাজ্যে।
মনু ছিলেন বৈদিক যুগের প্রথম গ্রন্থ প্রণেতা। বৈদিক সভ্যতায় দেবতারা ছিল ৩-শ্রেণির। যথা : মর্ত্যের (পৃথিবী ও অগ্নি), অন্তরীক্ষের (রুদ্র, বায়ু, বরুণ ও মেঘ) এবং স্বর্গ বা দ্যুলোকের (মিত্র, বিষ্ণু, আদিত্য, উষা, অদিতি, পুষণ, অশ্বিদ্বয়) প্রমুখ। দেবতাদের চেহারা সুরতও ছিল সপ্তপদী।
উষা মোহময়ী সুন্দরী হলেও, সূর্যদেবতা পূষণের ছিল আবার ছাগলের মত দাঁড়ি ও জটাধারী। রুদ্র বা শিব ৩-প্রকার দেবতার অন্যতম। উপনিষদে রুদ্রের ভাষ্য হচ্ছে, আমার আদি নেই, অন্ত নেই, আমি অনাদি। আমিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র ও শিব। বেদ অনুসারে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ ও বায়ু একই দেবতার নাম। ‘আদিত্য’ হচ্ছে আবার ১২-জন দেবতার একক নাম। বেদের দেবতারাই একটু নাম পাল্টে ইরানী আবেস্তায় রূপান্তরিত হয়েছিল এভাবেঃ মিত্র>মিথ্র, বরুণ>অসুর, মন্ত্র>মনথর, যজ্ঞ>যশ্ন।
২০১৪ সনের পৃথিবীর ন্যূনতম ১০০-কোটি মানুষের হিন্দু ধর্মের শুরু হয়েছিল ২৬০০-১৫০০ খ্রীস্টপূর্বে। এর মধ্যে বৈষ্ণব ছিল ৫৮ কোটি, শৈব ২২ কোটি, শাক্ত/স্মার্ত/আর্য ও অন্যান্য ১৫ কোটি। পার্থিব দেবতার মধ্যে অগ্নি প্রধান, ঋকবেদে ২০০ সূক্তে যার স্তব করা হয়েছিল। ঋকবেদ মতে রুদ্র ও শিব একই। শিব ছিল অনার্য দেবতা। দারিদ্র্যের কারণে মহা শক্তিধর দেবতা শিবকে ভিক্ষা করতে হয়েছিল। তার অপর নাম ছিল ভোলানাথ। সমুদ্রমন্থনে উত্থিত বিষ কণ্ঠে ধারণ করে শিব পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ বলে তার নাম ‘মহাদেব’। ত্রিশূলধারী শিবের অপর নাম ছিল ‘শূলপাণি’। ‘ভূতনাথ’ হিসেবেও অনেকে শিবকে চিনতো। শিবচতুর্দশী তিথিতে হিন্দুরা শিবরাত্রিব্রত ও শিবলিঙ্গে অর্ঘ্য নিবেদন করতো।
আবার ঋকবেদে অগ্নিদেবকেও রুদ্র বলা হয়েছিল। যজুর্বেদে বলা হয়েছে রুদ্র মুক্তিদাতা, ভেষজ ডাক্তার ও ধ্বংসের দেবতা। বেদ অনুসারে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ ও বায়ু একই দেবতার নাম। বৈদিক সাহিত্যে বরুণ ও ইন্দ্র কখনো এক, কখনো আলাদা স্বরূপে। নারায়ণ ও বিষ্ণু একই দেবতা, যার স্ত্রী লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণু ত্রিলোকের পালক এবং মধু ও কেটব নামে ২-দানবকে হত্যা করে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন নিজেই। তার নাভি থেকেই ব্রহ্মার উৎপত্তি। কালিকা পুরাণে আদিত্য সংখ্যা ছিল ১২ কিন্তু ঋকবেদে আদিত্য সংখ্যা ছিল ৬, তিত্তিরীয়ে ৮ এবং শতপথ ব্রাহ্মণে ১২ আদিত্যের কথা বলা হয়েছিল।
পুরাণ মতে, সূর্যই বর্ণিত আদিত্য। মৎস্য পুরাণ মতে, মনু সংহিতার রচয়িতা মনুর জন্ম ব্রহ্মা ও শতরূপার মিলন থেকে, শতরূপা নিজেই ছিল আবার ব্রহ্মার কন্যা। ভারতবর্ষের প্রাক বৈদিক উপাসনা ছিল মূলত লিঙ্গ ও যোনি-পুজো কেন্দ্রিক। রামায়ণ অনুসারে, দেবতা ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশ ধারণ করে গৌতমের স্ত্রীকে এবং বিষ্ণু প্রতারণা করে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা ও শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসীকে ভোগ করেছিলেন। চন্দ্র দক্ষের ২৭-টি মেয়েকে একত্রে বিয়ে করার পরও ৬০ কোটি সর্গের অপ্সরা নিয়ে ফস্টিনস্টি অব্যাহত রাখেন, আবার দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করে ধর্ষণ করলে জন্ম হয় ‘বুধ’-এর।
‘অথর্ববেদ’ সুপ্রসবের মন্ত্র, জ্বরের মন্ত্র, হৃদরোগ ও কুষ্ঠ রোগের মন্ত্র, শত্রুনাশের মন্ত্র, ক্রিমিরোগের মন্ত্র ইত্যাদি চিকিৎসা মন্ত্রে ঠাসা ছিল। মুন্ডমালাতন্ত্র মতে, ছাগ বলি দিলে বাগ্মী, মেষ বলিতে কবি, মহিষ বলিতে সম্পদ বৃদ্ধি এবং নরবলি দিলে মহাসমৃদ্ধি লাভ হতো। তবে ব্রাহ্মণ নিজহাতে নরবলি দিলে নরকে পতিত হতো। এ ক্ষেত্রে চন্ডালকে দিয়ে নরবলি দেওয়াতে হবে। যে চন্ডাল ব্রাহ্মণের নির্দেশ মত নরবলি দেবে, তার মহাসিদ্ধি লাভ হবে বলে বর্ণিত গ্রন্থে বলা হয়েছিল। বলি দেয়ার আগে মন্ত্র পাঠ করারর মন্ত্র ছিল ‘‘হুঁ বাগীশ্বরীব্রহ্মাভ্যাং নমঃ’’।
বৈদিক যুগে ভারতে চৌষট্টি যোগিনীর শক্তিপুজো চলতো, যার মন্দির তখনো খাজুরাহ, জববলপুর, ভুবনেশ্বরে বিদ্যমান ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদে চালু করা হয় ‘জন্মান্তরবাদ’। ‘জন্মান্তরবাদ’ মানে পূর্ব জন্মের কর্মফল। পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগ ছিল ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর, ত্রেতা যুগ ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর, দ্বাপর যুগ ৭ লক্ষ ৬৪ হাজার বছর, আর ২০১৪ সনের চলমান কলিযুগ স্থায়ী হবে ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বছর, সে হিসেবে বর্তমান ৩০১৪ সন এখনো কলিযুগের অন্তর্গত। হিন্দুমতে সাকুল্যে পৃথিবীর মানুষের বসবাসের ইতিহাস ৩৮ লক্ষ ৮৮ হাজার বছর! যদিও বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে মানুষ বসবাসের ইতিহাস ১ লক্ষ বছরের বেশী নয়। বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞে হাজার হাজার পশু বলি দেয়া হত। ভাগবত পুরাণে শিবকে উন্মাদ, শ্মশানচারী, অমঙ্গলকারী বলা হয়েছে। আবার হরিদ্রা ও মহা-গাণপত্যরা মনে করেন, গণেশ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা।
এর পর পর্ব # ৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন