শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৩০১৫ সনের পৃথিবীর মানুষ কিভাবে লিখবে ধর্মের ইতিহাস? হিন্দু ধর্ম : পর্ব # ৪ [ ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধমালা # ২১ ]

হিন্দু বা বৈদিক ধর্ম : পর্ব # ৪
[১ম, ২য় ও ৩য় পর্বের পর]

হিন্দু ধর্ম অনুসারে ঈশ্বরের অদেখা রূপের নাম ছিল ব্রহ্মা, আর সাকার ছিল সপ্তপদী দেবতারা। ঈশ্বরের সঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূলত প্রভু-দাসরূপে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, অন্য সম্পর্কটি ছিলো মা-সন্তানরূপে। দেবী দুর্গা ছিলো ঈশ্বরের মাতৃরূপ, দুর্গা পৃথিবীর সব শক্তি ও মায়ার আঁধার হিসেবে তাকে মহামায়া-মহাশক্তিও মনে করা হতো। তার ১০৮টি নামের মধ্যে প্রধান নাম ছিলো চন্ডী, কালী, পার্বতী, আনন্দময়ী, তারা, কাত্যায়নী, ত্রিনয়না, দশহাতী, উমা, মহিষাসুর মর্দিনী ইত্যাদি, এজন্যে ভগবান রাম ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দুর্গার পূজা করেছিলেন।

দেবী দুর্গার যোদ্ধা বাহিনীগুলো ছিল সিংহবাহিনী, দশভুজা, জটাজুটধারিণী ইত্যাদি। বিভিন্ন শক্তি ও দেবতাদের দ্বারা দুর্গা পরিবেষ্টিত থাকতেন। মেধষমুনির আশ্রম নিকটবর্তী করালডাঙার বেতসা নদীর তীরে রাজা ‘সুরথ ও সমাধি’ দুর্গাদেবীর প্রথম পূজা শুরু করেছিলেন বলে বিশ্বাস করতো হিন্দুরা।

এক জাতির পুজনীয় দেবতা, অন্য জাতির কাছে শয়তান রূপে পরিগণিত হতো ২০১৪ সনেও। দুর্গতি নাশ করতে পারেন এবং দুর্গম নামক অসুরকে বধ করার কারণে এ দেবীর নাম দুর্গা। দুর্গা ছিলেন জগতের সকল শক্তি ও মায়ার আধার। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পক্ষে যা অসম্ভব, তাও সম্পন্ন করতে পারতেন দেবী দুর্গা; যদিও দুর্গার প্রাপ্ত শক্তি সবগুলোই দানসূত্রে প্রাপ্ত ছিল,

যেমন দুর্গার অস্ত্রগুলোর মধ্যে ব্রহ্মা দিয়েছিলেন কমন্ডুলু, সূর্য প্রদান করেছিলে ধনুর্বাণ, বিষ্ণু দিলো চক্র, শিব দিয়েছিল শূল, চন্দ্র দিয়েছিল অষ্টচন্দ্র, যম দিয়েছিল দন্ড, কালদেব দিয়েছিল খড়গ, বিশ্বকর্মা দিয়েছিল বর্ম, কুবের দিয়েছিল রত্নরাজি। দুর্গার বসবাস ছিল মহাদেবের সঙ্গে শিতার্ত কৈলাশ পর্বতে, সেখান থেকে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে দুর্গা প্রতিবছর আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে বেড়াতে আসতেন বাবার বাড়ি মানে পৃথিবীতে। এই মর্তে আগমন উপলক্ষে ২০১৪ সনেও এই দেবীর পূজা করা হতো বিশ্বময় মহাসমারোহে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই ৩-দিন দেবীর চক্ষুদান, প্রাণ প্রতিষ্ঠা, মহাসণান, ১৬-শোপাচার নিবেদন, হোম, বলিদান, শাস্ত্রপূজা, অষ্টশক্তি সস্মম্বিতা দুর্গা, গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীর পূজা পালিত হতো উৎসব হিসেবে। সবশেষে পালিত হতো দেবীর বাহন তথা সিংহ, সাপ, ময়ুর, পেঁচা, হংস, মুষিক ও মহিষাসুরের পূজা।

দুর্গাদেবীর পূজায় প্রয়োজন হতো পতিতালয়ের মাটি, বল্মীক মাটি, শিশির হতে সপ্ত সমুদ্রের পানি, সপ্তপদী গন্ধ-ঔষধী, রত্ন ইত্যাদি। ৫-দিন পৃথিবীতে বাবার বাড়ি কাটানোর পর তিনি বিজয়া দশমীর দিনে বিসর্জনের মাধ্যম ফিরে যেতেন স্বামীগৃহ কৈলাশে। সর্বত্র বিরাজমান ছিল তার ১০-টি হাত। তবে তিনি ১০-হাতের ১০-টি অস্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে শুধু ত্রিশূল ও নাগপাশ ব্যবহার করতেন।

হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসে স্বর্গের অবস্থান ও বর্ণনা ছিলো নিম্নরূপঃ মেরু প্রদেশে পবিত্র পাহাড়ে উচ্চতম স্থানে স্বর্গ অবস্থিত। যার পাহাড়াদার ভীমরূপী ড্রাগন। নানা বৃক্ষ ছাড়াও ৪টি নদী বয়ে চলেছে স্বর্গের চারদিকে। ঐ সময়ের ভারতের নানাস্থানে নানাজনে নানা দেবদেবীর পূজো করতো যেমন রাজস্থানের উপজাতীয় দেবী ছিল অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী, গৌরি (ইনি শস্য দেবী), পাঞ্জাব-গুজরাটে ভবানী ও শীতলা দেবী, বিহারে চন্ডা, কালি, মনসা। বিদ্যার দেবী হিসেবে সরস্বতী, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা হিসেবে গণেশ, ক্ষাত্রশক্তির প্রতিক হিসেবে কার্তিক, বৈরাগ্যের প্রতিক দেবতা ছিলেন মহাদেব। বৈদিক ধর্মে সকল ঈশ্বরই নারী বিদ্বেষী ও নারীদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তথা উগ্র পুরুষতান্ত্রিক ছিলো। তবে ঐ সময়ে কিছু নিরীশ্বর ও যুক্তিবাদী মানুষেরও দেখাও মেলে ভারতে।

হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শ্রাদ্ধ প্রধানত ৩ প্রকার। আদ্যশ্রাদ্ধ, বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ ও সপিন্ডীকরণ। শ্রাদ্ধের আগের দিন মৃতের পুত্ররা লবণ ছাড়া আতপ চালের ভাত খেয়ে মাথামুন্ডন করতো। এ ছাড়াও মহালয়া, পার্বণশ্রাদ্ধ, একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ, অন্বষ্টকা শ্রাদ্ধ অনেকে পালন করতো। শ্রাদ্ধ বিষয়ক ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল শূলপাণির শ্রাদ্ধবিবেক ও রঘুনন্দনের শ্রাদ্ধতত্ত্ব।
বৈদিক যুগে হিন্দু দেবতার সংখ্যা ছিল ৩৩-কোটি। এই অসংখ্য দেবতাদের মনোরঞ্জনের জন্যে থাকতো আবার অসংখ্য উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, সুপ্রিয়ার মত প্রায় ৬০-কোটি সুন্দরী স্বর্গীয় অপ্সরা। ইন্দ্র থেকে কৃষ্ণ প্রায় প্রত্যেকেই কামাতুর দেবতা ছিলেন। পদ্মপুরাণ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬,১০০। হিন্দুধর্মের সতীদাহ রীতি অনুসারে শুধু ১৮১৫ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৮১৩৫ জন নারীকে সতীদাহ করে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৮৭ সনেও রূপ কানোয়ারকে রাজস্থানে সতীদাহ করা হয়েছিল।

বৈষ্ণবধর্ম রাধাকৃষ্ণের তত্ত্বভিত্তিক বৈষ্ণব মতবাদ ঈশ্বরপ্রেমের পরিবর্তে লৌকিক প্রেমে যা জড়িয়ে পড়েছিল। ব্রাহ্মরা উপনিষদে যে একক স্রষ্টা ব্রহ্মার কথা আছে, তাকে স্রষ্টা মানতো এবং বহু দেবতার বদলে এক আকারহীন ব্রহ্মার পুজো করতো, যাদেরকে কেউ কেউ হিন্দু বললেও, অপর গোষ্ঠী এদের ব্রাহ্ম বলতো। সনাতন হিন্দুদের মত, বিভিন্ন জাতপাতও ব্রাহ্মরা মানতো না। এরা ধর্মের ব্যাপারে অনেকটা উদারপন্থী ছিল। ঐ সময়ের ভারতের বিখ্যাত রাজা রামমোহন রায়, নোবেলজয়ী কবি ও তার পরিবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ছিলেন বলে জানা যায়। হিন্দু ধর্মে মতে তারাই প্রকৃত ঈশ্বর উপাসক ছিল এবং অন্য ধর্মীয়রা ভন্ড তথা মূল্যহীন ছিল।




[আপাতত শেষ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন