ইসলাম ধর্ম : পর্ব # ৪
[১ম, ২য় ও ৩য় পর্বের পর]
এ ধর্মে পূজনীয় কোন দেব-দেবী ছিলনা, কেবল নিরাকার আল্লাহর উপাসনা ছাড়া। ইসলাম ধর্ম মতে আল্লাহর ৪০০০ গুণবাচক নাম ছিল, তার মধ্যে ৩০০ তৌরাতে, ৩০০ যবুরে, ৩০০ ইঞ্জিলে ও বাকিগুলো কোরানের বিভিন্ন আয়াতে। যদিও ইসলাম ধর্মের অধিকাংশ রীতিনীতি ও নবীদের কাহিনী ইহুদীদের প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি ও কাহিনীর সাথে মিলতো, তারপরও মুসলমানরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দৈনিক কমপক্ষে ৫-বার ‘সালাত’ নামক প্রার্থনা করতো আল্লাহর ঘর বা ‘মসজিদ’এ। তা ছাড়া মুসলমানগণ বছরে কমপক্ষে ৩০-দিন রোজা রাখতো, মানে দিনে না খেয়ে থাকতো, বিশেষ পশুকে পবিত্র হত্যা করতো, যাকে তারা কুরবানী বলতো এবং তার মাংস আহার করতো।
মক্কা নগরীর একটি বিশেষ পবিত্র গৃহকে তারা ‘আল্লাহর ঘর’ তথা ‘কাবাঘর’ বলতো এবং ঐ ঘরটির চারপাশে ‘তাওয়াফ’ করতো। ঐ ঘরের কাছের দু’টো পবিত্র পাহাড়ে (যাকে তারা ‘সাফা- মারওয়া’ বলতো) তারা ইব্রাহিমপত্নী বিবি হাজেরার বিশেষ ঘটনার স্মরণে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতো, মক্কার পাশের আরাফাত নামক একটি মাঠে বিশেষ একটি দিনে সমবেত হতো, যাকে তারা পবিত্র ‘হজ্জের দিন’ বলতো। তা ছাড়া তারা মুজদালেফা, মিনা প্রভৃতি পবিত্র স্থানে গিয়ে ‘শয়তান’ তথা ‘মানুষকে প্ররোচনাকারী’র উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ করতো।
প্রার্থনা তথা নামাজের জন্যে অন্যদের বিশেষ শব্দ ও সুর করে ডাকতো, বর্ণিত পবিত্র ডাককে ‘আযান’ বলা হতো। মুসলমান পুরুষরা যে কোন রকম পোশাক পড়তে পারলেও, মুসলিম মহিলাদের শরীরের বিশেষ অংশ ঢেকে পোশাক পড়তে হতো। ইসলাম ধর্মে শুকরের মাংস ও মদ খাওয়া এবং সুদ দেয়া ও নেয়া হারাম তথা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ে মুসলমানদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিয়ে ছাড়া কোন পুরুষ ও মহিলা একত্রে বসবাস বা শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে বেত্রাঘাত কিংবা ‘রজম’ বা হত্যা করার বিধান ছিল ইসলাম ধর্মে। তবে ইসলামে একাধিক বিয়ে করার রীতি প্রচলিত ছিল।
ইহুদীদের মত খতনা ও মৃত্যুর পর মুসলমানদেরকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে মাটিতে একটি গর্ত করে ঢেকে দেয়া হতো, ঐ গর্তকে মুসলমানরা ‘কবর’ বলতো। মুসলমানদের বিশ্বাস ছিল যে, মৃত্যুর পর কবরে আল্লাহর তরফ থেকে ২-জন দেবদূত (যাকে তারা ফেরেস্তা বলতো) এসে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির হিসেব চাইবে ও নানাবিধ প্রশ্ন করবে, যারা ঐসব প্রশ্নের সঠিক জবাব ও হিসেব সঠিকভাবে দিতে পারবে না তাদের ‘কবর’ থেকেই তাৎক্ষণিক কঠিন শাস্তি দেয়া শুরু হবে, আর যারা সঠিক জবাব দিতে পারবে, তারা কবরে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবে ‘ফাইনাল জাজমেন্ট’ হওয়ার আগ পর্যন্ত।
মুসলমানরা কেবল তাদের ধর্মকেই ‘নিখুঁত’ মনে করতো, ঐ সময়ের প্রচলিত বাকি ধর্মগুলো মুসলমানদের বিবেচনায় ভেজালে পূর্ণ ছিল। কোরানে বিশ্বাসী ইসলামপন্থীদের মতে - তাওরাত, যবুর ও ইঞ্চিল আল্লাহ প্রদত্ত আসমানী কিতাব হলেও, তা ইহুদী ও খ্রীস্টানদের হাতে নানাভাবে ‘বিকৃত’ হয়েছিল বিধায়, সর্বশেষ আসমানী কিতাব কোরান সম্পূর্ণ ‘নিখুঁত’ ছিল। তা ছাড়া ইসলাম পৃথিবীতে প্রেরণের কারণে পূর্ববর্তী সকল ধর্ম ‘বাতিল’ হয়ে গিয়েছিল। আসমানী কিতাব অনুসারী ধর্ম (ইহুদী, খ্রীষ্টান) ছাড়া অন্য ধর্মগুলোর রীতিনীতি মুসলমানদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ ও ‘হাস্যকর’ ছিল। মুসলমানদের বিশ্বাস মতে ‘‘মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্ম অনুসারী কোন মানুষই স্বর্গ বা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’’।
এ ধর্ম মতে মৃত্যুর পর জান্নাত হবে ৮টি স্তর বা গ্রেডের। জান্নাতীদের উচ্চতা হবে ষাট হাত লম্বা এবং তাদের ঘাম থেকে মিশকের গন্ধ বের হবে। প্রত্যেককে ২-জন করে স্ত্রী দেয়া হবে, সাধারণ জান্নাতিও ৮০-হাজার খাদেম ও ৭২-জন হুর পাবে। জান্নাতে স্বর্ণখচিত আসন; উন্নত যৌবনা অপ্সরা; পবিত্র মদ; রেশমের আস্তর বিশিষ্ট ফরাস; কণ্টকহীন কুলবৃক্ষ; সম্প্রসারিত ছায়া; স্বচ্ছ শীতল পানি; দুধ ও মধুর স্রোতধারা; মাছের কলজে; পাখির মাংস; আংগুর-জয়তুন-ডুমুর জাতীয় ফল; স্বর্ণের চিরুণী; সুগন্ধময় ধূপদানী; উরুর হাড় মাংসের ভেতর দিয়ে দেখা যায় এমন [ট্রান্সপারেন্ট] স্ত্রী; ফাঁপা মুক্তার তৈরী ৬০-মাইল উচ্চতা বিশিষ্ট তাবু, যার প্রত্যেক কোনে থাকবে আয়তলোচনা (হুর) অপ্সরীরা; উচ্চতর বৃক্ষ, যা ১০০ বছরেও একটি দ্রুতগামী ঘোড়া দৌঁড়ে অতিক্রমে অক্ষম; শুক্রবারে বিশেষ বেহেস্তি বাজারের আয়োজন; অমর অধিবাসি; চিরকালিন সুস্থ্যতা; চিরযৌবনময়তা; চির সুখসময় ভোগের সামগ্রী ইত্যাদি। জান্নাতের তাবু হবে মোতির গাঁথুনি দেয়া;; বাসিন্দাদের আংটি আগরবাতির ন্যায় জ্বলজ্বল করবে; দরজা হবে ৮-টি, এর ভবনের ইট হবে মোতি নির্মিত ও মাটি হবে মেশক-এর (বোখারী-৩০০৩-৫,১৪,৮১,৯৫)।
আদন বেহেস্তের ঝরণায় ডুব দিলে কুৎসিত ব্যক্তিরও সুশ্রী মানুষে রূপান্তর ঘটবে (বুখারী-৪৩১৩)। সকল পাত্র ও জিনিস স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত হবে (বুখারী-৪৫১২)। হাউজে কাওসার নামক নহরের তীরে ফাঁপা মোতির তৈরী তাবু পাতা থাকবে (বুখারী-৪৫৯৫)। ‘বালাম’ ও ‘নুন’ (ষাঁড় ও মাছের কলজের অতিরিক্ত অংশ) হবে জান্নাতিদের তরকারি (বুখারী-৬০৭০)। হাউসে কাউসারের পানি হবে দুধের মত সাদা, ঘ্রাণ হবে মৃগনাভীর চেয়ে অধিক, পান-পাত্র হবে নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বল (বুখারী-৬১২২)। হাউসের দূরত্ব/দৈর্ঘ হবে মদীনা থেকে সানা’র দূরত্বের সমান (বুখারী-৬১৩২)। ২-টি জান্নাতের পানপাত্রসহ সব কিছুই হবে সোনার, আবার ২-টি জান্নাতের পানপাত্রসহ সব কিছুই হবে রূপার (বুখারী-৬৯২৬)। ইসলামের নবীকন্যা ফাতিমা জান্নাতী নারীদের নেত্রী হবেন (বুখারী-৩৩৫৪)। জান্নাতের প্রতিটি গাছের ডালপালা স্বর্ণের তৈরী, কক্ষগুলো হবে ট্রান্সপারেন্ট, একশত স্তর বিশিষ্ট, ৭০-জোড়া কাপড়ের ভেতর থেকে জান্নাতী নারীর পায়ের গোছার উজ্জ্বলতা দেখা যাবে।
প্রত্যেক পুরুষকে ১০০-জনের সমান যৌনশক্তি দেয়া হবে; জিনিসপত্র সূর্যের চেয়ে বেশি আলোকজ্জ্বল; অধিবাসীর দেহে লোম, দাঁড়ি-গোফ থাকবেনা; চোখে সুরমা লাগানো থাকবে; কাপড় কখনো পুরণো হবেনা; আসমান-যমীনের সমান সুউচ্চ বিছানা থাকবে; গাছের ফল হবে মটকার মতো; পতঙ্গগুলো হবে সোনার; পাখিগুলোর ঘাড় উটের ঘাড়ের মতো উঁচু হবে; ডানাওয়ালা মনিমুক্তার উড়ন্ত ঘোড়া থাকবে; অধিবাসী যুবকদের বয়স হবে সকলের ৩০-৩৩ বছর; প্রবেশদ্বার হবে দ্রুতগামী ঘোড়ার ৩-দিনের পথ; জান্নাতবাসীরা মেশক, কস্তুরী ও কর্পুরের স্তুপের উপর আসন পাবে; আল্লাহকে তারা সামনা সামনি দেখবে, কথা বলবে ও আল্লাহ তাদেরকে ‘অমুকের পুত্র অমুক’ বলে ডাক দেবে; মেঘ ছায়া দেবে ও সুগন্ধীযুক্ত বৃষ্টি বর্ষাবে; বেহেস্তি বাজার থেকে ফিরে এসে নিজ নিজ স্ত্রীদের সাক্ষাত মিলবে; জান্নাতি বাজারে শুধু নারী-পুরুষের প্রতিকৃতি বিক্রয় হবে; সাধারণ জান্নাতির জিনিসপত্র দেখতে চাইলেও তা হাজার বছরের দূরত্বের রাস্তার সমান হবে; বাইরে কষ্ট মুছিবতের জিনিস দ্বারা বেহেস্ত পরিবেষ্টিত থাকবে;যমরুদ ও ইয়াকুতের তাবু থাকবে; মাথায় মুক্তাখচিত মুকুট পড়ানো হবে; পানি, মধু, দুধ ও শরাবের সাগর থাকবে; হুর-রা সমবেত হয়ে গান গাইবে; জান্নাতে মুসলমানদের থাকবে ৮০টি কাতার ও অন্য সকল নবীদের থাকবে ৪০টি কাতার (তিরমিযী-২৪৬২-২৫১০)। হাওযে কাওসারের পানপাত্রের সংখ্যা হবে গ্রহ ও তারকারাজির সংখ্যার চাইতেও বেশি; জান্নাত বিস্মৃতি হবে কুফা থেকে হাজরে আসওয়াত পর্যন্ত (তিরমিযী-২৩৮৭); জান্নাতের সুগন্ধ ৪০-বছরের দূর থেকেও পাওয়া যাবে (বুখারী-৬৪৩৪)। জান্নাতের সুবাস ৭০-বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যাবে (তিরমিযী-১৩৪৩)।
লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন