শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কুরাইশ মুসলিম বদর যুদ্ধের করুণাত্মক হত্যা পর্ব : ২ [ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ # ৩৭ ]

কুরাইশ মুসলিম বদর যুদ্ধের করুণাত্মক হত্যা পর্ব :২
হেকটর-একিলিস বধের ট্রাজেডিকে হার মানায় যে বর্ণনা!
[মুসলিম ঐতিহাসিকের বর্ণনা]
:
কুরাইশ নেতা ওতবা বিন রাবিয়া যুদ্ধ না করেই ফিরে যাওয়া স্থির করেন কিন্তু -------- !
:
‘হাকিম বিন হিজাম তাঁর [উমায়ের বিন ওহাব আল যুমাহির] যুদ্ধ শুরুর কথাগুলো শোনার পর লোকজনের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে ওতবা বিন রাবিয়ার কাছে যান এবং তাঁকে বলেন: “হে আবু ওয়ালিদ, আপনি কুরাইশদের নেতা ও অধিপতি যার আজ্ঞা তারা পালন করে। আপনি কি ভবিষ্যতে তাদের প্রশংসা নিয়ে স্মরণীয় হতে চান?” ওতবা বিন রাবিয়া বলেন, “হাকিম, তা কীভাবে সম্ভব?” 

হাকিম উত্তরে বলেন, “আপনার পরিচালনায় তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং আপনার মিত্র আমর বিন আল-হাদরামীর খুনের ঘটনাকে ভুলে যান।”

ওতবা বলেন, “আমি তাই করবো এবং তুমি তার সাক্ষী: সে ছিল আমার আশ্রয়ে, তাই আমার কর্তব্য হলো তার খুনের রক্ত-মূল্য এবং ছিনতাই হওয়া সম্পদের ক্ষতিপূরণ (তার আত্মীয়দের কাছে) পরিশোধ করা। তুমি ইবনে আল হানজালিয়ার [আবু জেহেল বিন হিশাম] কাছে যাও; কারণ আমার আশঙ্কা সেইই ঝামেলা করতে পারে, অন্য কেউ নয়।” [উল্লেখ্য আবু জেহেল অন্য কুরাইশ গোত্রের নেতা ছিলেন]।
:
তারপর ওতবা উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘হে কুরাইশগণ! আল্লাহর দোহাই, ইসলামের নবী মুহাম্মদ ও তার সহচরদের সাথে যুদ্ধ করা অর্থহীন। যদি তোমরা তাদেরকে আক্রমণ করো, তোমরা সর্বদাই বিতৃষ্ণ চোখে প্রত্যেকেই প্রত্যেক সহচরদের দিকে তাকিয়ে দেখবে যে, তোমারই এক সহচর খুন করেছে তোমারই কোনো চাচাতো ভাইকে, কিংবা মামাতো ভাইকে বা আত্মীয়-স্বজনকে। সুতরাং ফিরে চলো এবং মুহাম্মদকে বাকি আরবদের হাতে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে হত্যা করে, তবে তোমরা তো তা-ই চাও; যদি তা না হয়, তবে সে বুঝবে যে, তাকে তোমরা হত্যা করার চেষ্টা করোনি যা (আসলে) ছিল তোমাদের পছন্দ।’"
:
ওতবা জানতে পারেন যে, আবু জেহেল তাঁকে বিদ্রূপ করেছে, তিনি বলেন, “নোংরা, সে দেখতে পাবে যে কার আত্মা সিক্ত [ভয়ে]; তার না আমার।" তারপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে, জনগণ অনমনীয় ভাবে অশুভ কাজে লিপ্ত হয় এবং ‘ওতবার’ উপদেশ তাদের কোনো কাজে আসে না। অতঃপর, ওতবা (বাধ্য হয়ে) তার শিরস্ত্রাণ মাথায় পরার জন্য খোঁজেন; কিন্তু তাঁর মাথাটি এত বড় ছিল যে, সেই মাপের কোনো শিরস্ত্রাণ তিনি সৈন্যদলে খুঁজে পান না, তিনি এক টুকরা কাপড় তাঁর মাথায় পেঁচিয়ে যুদ্ধ ময়দানে এগিয়ে যান।’ 
===================================================

এরপর কুরাইশ আর মুসলিমদের যুদ্ধ শুরু হয়, যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ :
:
১] ওতবা বিন রাবিয়া, তার ভাই সেইবা এবং ছেলে আল-ওয়ালিদকে হত্যা :

‘আল-আসওয়াদ বিন আবদুল আসাদ আল-মাখযুমির পর ওতবা বিন রাবিয়া তাঁর ভাই সেইবা ও ছেলে আল-ওয়ালিদ কে তাঁর দুই পাশে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। যুদ্ধের স্থানে পৌঁছে তিনি একক দ্বন্দ্বযুদ্ধ আহ্বান করেন। মদিনার আনসারদের মধ্য থেকে তিন ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন: হারিথের দুই ছেলে আউফ ও মুয়ায়িদ (তাঁদের মায়ের নাম ছিল আফরা) এবং আবদুল্লাহ বিন রাওয়া নামের অন্য এক ব্যক্তি।

কুরাইশরা বলেন, "তোমরা কে?" তাঁরা উত্তর দেন, "আমরা আনসার দলের কিছু লোক।"
তখন সেই তিনজন কুরাইশ বলেন, "তোমাদের সাথে আমাদের কোনোই বিবাদ নেই।"

তারপর তাঁরা উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, "হে মুহাম্মদ! আমাদের বিপক্ষে আমাদেরই গোত্রের [কুরাইশ] কোনো ব্যক্তিকে পাঠাও।" আল্লাহর নবী বলেন, "হে ওবায়েদা বিন হারিথ, হামজা ও আলী উঠে এসো।" যখন তাঁরা উঠে সামনে এগিয়ে আসেন, কুরাইশরা বলেন, "কে তোমরা?" তাঁদের নামের ঘোষণা শোনার পর তাঁরা বলেন, "হ্যাঁ, এরাই হলো উচ্চ-বংশ এবং আমাদের সমকক্ষ।"
:
ওবায়েদা ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বয়স্ক। তিনি ওতবা বিন রাবিয়ার, হামজা সেইবাহ বিন রাবিয়ার এবং আলী আল-ওয়ালিদ বিন ওতবার মুখামুখি হন। খুব শীঘ্রই হামজা সেইবাহকে এবং আলী আল-ওয়ালিদকে হত্যা করেন। ওবায়েদা এবং ওতবা একে অপরকে বার দুই আঘাত করে একে অপরকে ধরাশায়ী করেন। হামজা ও আলী তাঁদের তলোয়ার নিয়ে ওতবার দিকে ফিরে আসেন এবং তাঁকে হত্যা করে ওবায়েদাকে তাঁদের অনুসারীদের কাছে নিয়ে আসেন। তাঁর [ওবায়েদা] ঠ্যাং বিচ্ছিন্নভাবে কেটে গিয়েছিল এবং তা থেকে অস্থিমজ্জার ক্ষরণ হচ্ছিল।’ 
:
২] আবু আল বাখতারি (আল আস) বিন হিশামকে হত্যা :
:
'আনসার বানু সালিম বিন আউফ গোত্রের মিত্র আল মুযাধধার বিন ধিয়াদ আল বালাওয়ি নামের এক ব্যক্তি আবু আল বাখতারি বিন হিশামের সাক্ষাৎ পান। আল মুযাধধার বিন ধিয়াদ তাঁকে বলেন যে, আল্লাহর নবী তাদেরকে বলেছেন, তারা যেন তাঁকে [আবু আল বাখতারি] হত্যা না করে। আবু আল বাখতারির সাথে ছিলেন তাঁর সহ-আরোহী (Rider) জুনাদা বিন মুলেইহা, যিনি তাঁরই সাথে মক্কা থেকে আগমন করেছিলেন। জুনাদা ছিলেন বানু লেইথ গোত্রের সদস্য এবং আবু আল বাখতারির পুরা নাম ছিল আল আস বিন হিশাম বিন আল হারিথ বিন আসাদ। তিনি [আবু আল বাখতারি] বলেন, "সে ক্ষেত্রে আমার বন্ধুর (সহ-আরোহী) কী হবে?" আল মুযাধধার বলেন, "না, আল্লাহর কসম। আমি তোমার সহ-আরোহীকে ছাড়বো না। আল্লাহর নবী শুধু তোমার ব্যাপারেই এই হুকুমটি দিয়েছেন।" তিনি [জবাবে] বলেন, "সেক্ষেত্রে, আমি তার সাথেই মরবো। মক্কার মেয়েরা যেন কখনোই বলতে না পারে যে, আমি আমার নিজের জীবন বাঁচাতে আমার এক বন্ধুকে পরিত্যাগ করেছিলাম।" তিনি দৃঢ়কন্ঠে যুদ্ধ আহ্বান করেন। পরিণতিতে আল মুযাধধার তাঁকে করেন হত্যা। তারপর আল মুযাধধার নবীর কাছে যান এবং তাঁকে বলেন যে, তিনি আল বাখতারিকে বন্দী করে তাঁর কাছে নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁর যুদ্ধ-জেদের কারণে তাঁকে খুন হতে হয়েছে।’ [এক কুরাইশ কর্তৃক বন্ধুর জন্যে জীবন দান]
:
৩] আবু জেহেল কে হত্যা :
:
শত্রুদের সাবাড় করার পর আল্লাহর নবী নিহতদের মধ্য থেকে আবু জেহেলকে খোঁজার নির্দেশ জারি করেন এবং বলেন, "হে আল্লাহ, সে যেন তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে না পারে!" যে লোকটি সর্ব প্রথম আবু জেহেলকে দেখতে পান, তিনি হলেন সালামাহর ভাই মুয়াদ বিন আমর বিন আল-যুমাহ। তাঁদের বর্ণনা মতে তিনি [মুয়াদ বিন আমর] বলেছেন, "আমি শুনলাম, লোকেরা বলছে যে, আবু জেহেল ঝোপ (Thicket) বুঝে চলছে এবং তারা বলাবলি করছে, 'আবু আল হাকামকে ধরা যাবে না।'" এটা শুনে আমি তাকে ধরার জন্য মনোনিবেশ করি। তাকে ঘা-মারার দূরত্বে পৌঁছে আমি তার উপর সজোরে আঘাত করি, এতে তার পা এবং ঠ্যাং এর অর্ধেক ছিন্ন হয়ে ছিটকে পরে। সে ঘটনার তুলনা আমি শুধুই খেজুর গুঁড়া করার সময় খেজুর বিচি ছিটকে পরার সাথেই করতে পারি। তার ছেলে ইকরিমা আমার কাঁধে আঘাত করে এবং তাতে আমার বাহু কেটে যায়, ফলে সেটা আমার পাশে চামড়ার সাথে ঝুলে থাকে এবং সে অবস্থায় আমি লড়াইয়ের প্রয়োজনে তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হই। কাটা হাতটাকে আমার পেছনে টেনে নিয়ে সারাদিন আমি যুদ্ধ করি এবং যখন তা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে আমি আমার পা তার ওপর উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষণ না তা ছিন্ন হয়ে যায়।" মুয়াদ এই ঘা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং ওসমান বিন আফফানের খেলাফত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তারপর মুয়ায়িদ বিন আফরা আবু জেহেলকে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাকে আঘাত করতেই থাকেন, যতক্ষণ না আবু জেহেল নড়া-চড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় তিনি তাকে ফেলে আসেন। পরে ফিরে গিয়ে মুয়ায়িদ তাকে হত্যা করেন।
:
আবদুল্লাহ বিন মাসুদ বলেন যে, তিনি আবু জেহেলের শেষ নিঃশ্বাসের সময় তাকে দেখতে পান এবং তাঁর পা তার [আবু জেহেলের] গর্দানের উপর ঠেসে ধরেন (কারণ সে মক্কায় তাকে একবার নখের আঘাত ও ঘুষি নিক্ষেপ করেছিল) এবং তাকে বলেন, "তুই আল্লাহর শত্রু। আল্লাহ তোকে কলঙ্কিত করেছে।" জবাবে সে বলে, "কীভাবে সে আমাকে কলঙ্কিত করেছে? তোরা যে মানুষদের খুন করেছিস, তাদের চেয়ে কি আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? বল্ তো, কে বিজয়ী হয়েছে?" আবদুল্লাহ তাকে বলেন যে, বিজয়ী হয়েছে আল্লাহ ও তার রসুল।
:
আবদুল্লাহ বিন মাসুদ বলতেন, "আবু জেহেল আমাকে বলেছে, 'এই ছোট্ট মেষপালক, তোর বার বেড়েছে'। তারপর আমি তার মাথা কেটে ফেলি এবং আল্লাহর নবীর কাছে তা নিয়ে এসে বলি, “এই সেই আল্লাহর শত্রু আবু জেহেলের মুণ্ডু। "তখন আল্লাহর নবী আমাকে বলেন, "আল্লাহর কসম, তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই, তাই না?" আমি বলি, "হ্যাঁ, এবং তার কাটা মুন্ডু আল্লাহর নবীর সামনে ছুড়ে মারি, তিনি আল্লাহ কে ধন্যবাদ জানান।"

=====================================================
সূত্র : “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ২৯৬-৩০৪; পৃষ্ঠা ২৯৮। “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৭, ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩০৯-১৩৩১; আল তাবারী – পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩১৭-১৩১৮, ইসলামের নবী মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ২৯৮-২৯৯, ইসলামের নবী মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৩০১-৩০২, আল তাবারী -পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩২৪-১৩২৫, ইসলামের নবী মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৩০২-৩০৩, আল তাবারী -পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩২৫-১৩২৭, ইসলামের নবী মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৩০৪, আল তাবারী -পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩২৯-১৩৩১।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন