শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইসলামের ইতিহাস : নাখলা অভিযান : যুদ্ধের শুরু যেভাবে ! [ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ # ৩৪ ]

ইসলামের ইতিহাস : নাখলা অভিযান : যুদ্ধের শুরু যেভাবে !
:
‘আল্লাহর নবী আবদুল্লাহ বিন জাহাশকে একটি চিঠি লিখেন। কিন্তু তাঁকে আদেশ করেন যে দুই দিনের রাস্তা অতিক্রম করার আগে যেন তিনি সেই চিঠিটি না পড়েন। দুই দিনের রাস্তা অতিক্রান্তের পর আবদুল্লাহ বিন জাহাশ সেই চিঠিটি পড়েন। সেই চিঠিতে আদেশ ছিল, "তুমি মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে যাও। সেখানে কুরাইশদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে জানার চেষ্টা করো যে তারা কি করছে”।
:
ঐ দলের সদস্য সাদ বিন আবি ওয়াককাস এবং ওতবা বিন গাজওয়ান তাদের একটি উট হারিয়ে ফেলে। সেই উটটিতে তাঁরা পালাক্রমে আরোহণ করছিলেন। উটটি খুঁজতে যাবার কারণে তাঁরা আবদুল্লাহ বিন জাহাশের থেকে পিছিয়ে পরে। আবদুল্লাহ বিন জাহাশ তাঁর অবশিষ্ট সঙ্গীদের নিয়ে নাখলায় পৌঁছেন । নাখলায় পৌঁছে তিনি দেখতে পান যে কিসমিস, চামড়া ও অন্যান্য বাণিজ্য সামগ্রী ভর্তি কুরাইশদের কাফেলার বহর তাদের অতিক্রম করছে। আরোহী কুরাইশদের মধ্যে ছিলেন 'আমর বিন আল হাদরামি, ওসমান বিন আবদুল্লাহ এবং তার ভাই 'নওফল বিন আবদুল্লাহ' ও 'আল হাকাম বিন কেইসুন'। আরোহী কুরাইশরা মদিনার মুসলমানদেরকে দেখতে পেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পরেন। কারণ, মুসলমানরা তাদের খুবই নিকটে অবস্থান নিয়েছিল। সে অবস্থায় তাঁরা "মস্তক মুণ্ডিত" উককাশা বিন মিহসান কে দেখতে পায়। তাঁকে দেখে তাঁরা স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করেন এবং বলেন, “এরা উমরাহ্ যাত্রী পথিক, এদেরকে ভয় পাবার কোন কারণ নাই !”
:
নবী প্রেরিত মুসলমানেরা একে অপরের সাথে কুরাইশদের কাফেলা সম্পর্কে পরামর্শ করে। সেটি ছিল রজব মাসের শেষ দিন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁরা কুরাইশদের কাফেলা আক্রমণ করে যত জনকে পারবেন খুন করে তাদের কাছে যা কিছু আছে তা লুন্ঠন করবেন। বিনা উসকানিতে ওয়াকিদ বিন আবদুল্লাহ আল তামিমি (মুসলমান) তাঁর ধনুকের তীর নিক্ষেপ করে আমর বিন আল-হাদরামীকে (কুরাইশ) হত্যা করে। ভয়ে ওসমান বিন আবদ-আল্লাহ ও আল হাকাম বিন কেউসুন মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং নওফল বিন আবদ-আল্লাহ প্রাণভয়ে মক্কা পালিয়ে যান। মুসলমানেরা তাকে ধরতে ব্যর্থ হয়। 
:
আবদুল্লাহ বিন জাহাশ এবং তাঁর সঙ্গীরা কুরাইশদের বাণিজ্যফেরত কাফেলা বহর এবং দুইজন বাণিজ্য আরোহীকে বন্দী করে মদিনায় আল্লাহর নবীর কাছে প্রত্যাবর্তন করেন। সেটি ছিল রজব মাস মানে আরবদের পবিত্র মাসের একটি। যে মাসে কোনোরূপ সহিংসতা বিশেষভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহর নবী কুরাইশদের বাণিজ্যফেরত কাফেলার মালামাল এবং দুইজন বন্দীকে হস্তগত করেন। স্বজনদের মুুক্তিতে কুরাইশরা তাঁর কাছে বন্দী ওসমান বিন আবদ-আল্লাহ ও আল হাকাম বিন কেউসুনের মুক্তির চেষ্টায় মুক্তিপণ পাঠায়। 
:
কিন্তু আল্লাহর নবী বলেন, "আমার দুইজন অনুসারী (সাদ বিন আবি ওয়াককাস ও ওতবা বিন গাজওয়ান) ফিরে আসার আগ পর্যন্ত এই বন্দীদেরকে আমরা মুক্তি পণের বিনিময়েও ছাড়বো না। কারণ, আমাদের আশংকা তোমরা তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারো। যদি তোমরা আমাদের ঐ দুইজন সহকারীকে হত্যা করো, তবে আমরাও এই দুইজন বন্দী কে হত্যা করবো।" অত:পর, সাদ ও ওতবা ফিরে আসেন। আল্লাহর নবী বন্দী দুই জনকে মুক্তি পণের বিনিময়ে ছেড়ে দেন।...
:
আবদ আল্লাহ বিন জাহাশের পরিবারের কিছু লোক বর্ণনা করেন যে, তিনি (আবদ আল্লাহ বিন জাহাশ) তাঁর অনুসারীদের বলতেন, "আল্লাহর নবী লুণ্ঠিত সম্পদের (গণিমত) এক-পঞ্চমাংশ নিজের অধিকারে রাখতেন।" এই ব্যবস্থাটি ছিল আল্লাহর নির্দেশিত বাধ্যতামূলক এক-পঞ্চমাংশ লুণ্ঠিত সম্পদ নবীর জন্য গচ্ছিত রাখার হুকুম জারীর পূর্বে (খুমস অথবা খামুস)। তিনি সেই লুণ্ঠিত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ নবীর জন্য সরিয়ে রেখে অবশিষ্ট লুণ্ঠিত সম্পদ তার সহগামী বা অনুসারীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেন।
:
আবদুল্লাহ বিন জাহাশের নেতৃত্বে নাখলার এই বাণিজ্য ফেরত কাফেলায় হামলা, একজন নিরপরাধ আরোহীকে খুন এবং দুইজন নিরপরাধ মুক্ত-মানুষকে বন্দীর কদর্য ঘটনাটি যে রাত্রিতে সংঘটিত হয়, তা ছিল রজব মাসের শেষ দিন। আরবরা বংশ-পরম্পরায় যে মাসটিকে পবিত্র জ্ঞানে যাবতীয় হামলা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুন-খারাবী পরিহার করে এসেছেন। তৎকালীন আরবে যিলকদ, যিলহ্জ, মুহররম ও রজব- এই চারটি মাসকে “সম্মানিত মাস” রূপে বিবেচনা করা হতো। এ মাস গুলোতে কোনো প্রকার বিবাদ-ফ্যাসাদ, খুনাখুনি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ করাকে আরবরা খুবই গর্হিত বিবেচনা করতেন। মদিনার মুসলমানদের কাছে এ ঘটনার যৌক্তিকতা থাকলেও, মক্কার কুরাইশদের কাছে এটি ছিল ১০০% ডাকাতি। এ ঘটনায় ধারাবাহিকতায় মক্কার কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম আক্রমন থেকে রক্ষার পথ খুঁজতে থাকে। 

======================================================

সূত্র : ১) “সিরাত রসুল আল্লাহ”- ইবনে ইসহাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৯
http://www.justislam.co.uk/product.php?products_id=218; ২) “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৭, ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-88706-344-6 [ISBN 0-88706-345-4 (pbk)], পৃষ্ঠা (Leiden) ১২৭৪-১২৭৯ http://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_ibn_Jarir_al-Tabari ; ৩) “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক: আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ১৩-১৯

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন